বানতলায় ম্যানহোলে মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত হবে বলে জানালেন ফিরহাদ হাকিম। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
বিধি শিকেয়। ম্যানহোলের পাঁকে-চক্রে শহরে ফের বেঘোরে প্রাণ গেল তিন সাফাইকর্মীর। প্রশ্ন উঠছে, বানতলার লেদার কমপ্লেক্সের ঘটনার দায় কার? কার নির্দেশে ম্যানহোলে নেমেছিলেন সাফাইকর্মীরা? নিকাশি নালায় নামার সময়ে সুরক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না। বিতর্ক তৈরি হয়েছে কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ক্ষতিপূরণ-ঘোষণা নিয়েও। বিতর্কের কারণ, সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেননি মন্ত্রী। যা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা, তার এক ভাগ দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি!
রবিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃত তিন সাফাইকর্মীর পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন ফিরহাদ। মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘নির্দেশ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেব আমরা। ১০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।’’ এ দিকে ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভট্ট এবং বিচারপতি অরবিন্দ কুমারের বেঞ্চ জানিয়েছিল, নিকাশি নালা পরিষ্কার করতে নেমে সাফাইকর্মীর মৃত্যু হলে ৩০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারকে। সেই রায়ের প্রতিলিপির ৪৫ এবং ৪৬ নম্বর পাতায় সে কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, ম্যানহোলে নেমে কোনও সাফাইকর্মীর শরীরের কোনও অঙ্গ স্থায়ী ভাবে অকেজো হয়ে গেলে তাঁকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ২০ লক্ষ টাকা দিতে হবে। তবে ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ কখনওই ১০ লাখের কম হবে না।
বানতলায় সাফাইকর্মীদের মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও কেন ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করলেন রাজ্যের মন্ত্রী, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রে খবর, মন্ত্রী প্রাথমিক ভাবে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের রায় খতিয়ে দেখে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আদালতের বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও যে ম্যানহোলে মানুষ নামিয়ে সাফাইয়ের কাজ চলে, বানতলার ঘটনায় তা আরও এক বার প্রমাণিত। কয়েক বছর আগে দক্ষিণ কলকাতার কুঁদঘাটে একটি ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশনের ম্যানহোলে নেমে প্রাণ গিয়েছিল চার জনের। এ বার বানতলায় মৃত্যু হল তিন জনের। প্রথমে এক জন নেমেছিলেন নালায়। দীর্ঘ ক্ষণ পরেও তিনি উঠে না আসায় আরও দু’জন নামেন। ঘণ্টা চারেক পর সকলেরই দেহ উদ্ধার হয়। তিন জনেই কেএমডিএ-র অস্থায়ী কর্মচারী। লেদার কমপ্লেক্সের ভিতরে সেক্টর ৬ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অধীনে সাফাইয়ের কাজ করছিলেন তাঁরা।
সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার পরেও কেন বানতলায় শ্রমিক দিয়ে ম্যানহোল পরিষ্কার করানো হল? ফিরহাদ বলেন, ‘‘নির্দেশিকা অনেক সময় মানেন না শ্রমিকেরা। আমার কিছু হবে না ভেবে নেমে পড়েন। এতেই বিপদ হয়। মুখ্যমন্ত্রী বললেন এখনই যাও। আমি দৌড়ে চলে এলাম। থানা তদন্ত করবে। থানার বড়বাবু আছেন। উনি এখান থেকে রিপোর্ট দেবেন। ঠিকাদারকে বলেছি যেতে। পুরসভাও তদন্ত করবে। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
বানতলার ঘটনার জন্য যে বা যাঁরা জড়িত, তাঁদের কাউকে ছাড়া হবে না বলে আশ্বাসও দিয়েছেন ববি। মন্ত্রীর কথায়, ‘‘যে বা যারা দায়ী, কাউকে ছাড়া হবে না। ঠিকাদার যদি দায়ী হয় বা কোনও আধিকারিক, কাউকে ছাড়া হবে না। তিন গরিব মানুষের প্রাণ গিয়েছে। এটা উত্তরপ্রদেশ নয় যে, এতগুলি প্রাণ গেল আর চেপে যাব। আমাদের এখানে প্রত্যেকটা প্রাণের দাম আছে। তদন্তে দোষীকে শাস্তি দেওয়া এবং এ থেকে শিক্ষা নিয়ে অর্ডার জারি করা হবে।’’
নিয়ম অনুযায়ী, ম্যানহোলে নামার আগে জেনে নিতে হয়, ভিতরে বিষাক্ত গ্যাস আছে কি না। তার জন্য যে যন্ত্র লাগে, তা অবশ্য থাকে না সাফাইকর্মীদের। ম্যানহোলের ঢাকনা খোলার পর তাঁরা দেখে নেন, ভিতরে আরশোলা ঘুরছে কি না। যদি আরশোলা থাকে, তবেই তাঁরা নিশ্চিন্ত হন। আর যদি আরশোলা বা অন্য কোনও পোকা না থাকে, তা হলে ধরে নেওয়া হয়, ম্যানহোলে মিথেন গ্যাস রয়েছে। কারণ, ওই গ্যাস জমে থাকলে কোনও প্রাণীই বাঁচে না। শুধু তা-ই নয়, ম্যানহোলে নামার সময় শ্রমিকদের মাথা থেকে পা বিশেষ ধরনের অ্যাপ্রনে ঢাকা থাকা উচিত। পায়ে থাকা উচিত গামবুট এবং হাতে দস্তানা। কোমরে বাঁধা থাকবে বিশেষ ধরনের দড়ি। মাথায় হেলমেট। প্রয়োজনে পরতে হবে বিশেষ ধরনের মুখোশও। সঙ্গে অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখাও বাধ্যতামূলক।
এই সব কড়া নিয়ম রয়েছে ঠিকই, তবে তা বন্দি খাতায়-কলমেই। অভিযোগ, বিধি উড়িয়ে এখনও স্রেফ গামছা-বালতির ভরসাতেই ম্যানহোলে নেমে পাঁকে-চক্রে খাবি খান সাফাইকর্মীরা। অভিযোগ, বানতলার সে রকমই ঘটেছে। ফিরহাদ বলেন, ‘‘কোনও গরিব মানুষ মারা গেলে তাঁর মৃত্যুর কারণ জানা যাবে না, এটা হতে পারে না। চিফ ইঞ্জিনিয়ার বলছেন, গ্যাস তৈরি হচ্ছে লিকেজ থেকে। কেন তা হলে ঠিক মতো ইনস্পেকশন হল না? কেন শ্রমিককে নামানো হল? পাম্প লাগিয়ে পরিষ্কার করা হল না কেন? বিষাক্ত গ্যাস আছে কি না, দেখা হল না কেন? থানা তদন্ত করবে।’’
ফিরহাদের সংযোজন, ‘‘পরিবেশটা নরককুণ্ড হয়ে রয়েছে। আমাদের এখানকার নেতা রাকেশও বলছিল। সবাই ডিসচার্জ করে দিচ্ছে। এটা লেদার প্রসেসিংয়ের জল, কেমিক্যাল রয়েছে। এটা সিএপিডি-তে যাওয়ার কথা। রাস্তায় যাচ্ছে বলে বিক্রিয়া ঘটে গ্যাস সৃষ্টি হচ্ছে।’’