মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
শুধু বর্ধিত ডিএ চাইলেই হবে না, রাজ্যের পরিস্থিতিও বুঝতে হবে। রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের কার্যত আরও একটু ধৈর্য ধরতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, ঋণ শোধ করার পর যেটুকু অর্থ বেঁচে থাকে তা দিয়েই রাজ্যের উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়। এ বছরেই ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ করেছে রাজ্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন ‘জনমুখী’ প্রকল্প চালাতে অর্থ প্রয়োজন। সেই প্রকল্পগুলো বন্ধ করে ডিএ বাড়ানো কঠিন বলে সোমবার সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করছি। রাজ্যবাসীর জন্য খাদ্যসাথী, কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, সমব্যথী-র মতো প্রকল্পগুলো চালু করেছে সরকার।” পাশাপাশি তিনি মনে করিয়ে দেন, খাদ্যসাথী প্রকল্পের অধীনে ২ টাকায় চাল দেওয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, সমব্যথী, সবুজসাথীর মতো প্রকল্পগুলির সুবিধা পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এর পরই তাঁর মন্তব্য, সব বিনা পয়সায় চললে সরকারকে তো টাকাটা জোগাড় করতে হবে!
এর পরই তিনি মহার্ঘ ভাতার প্রসঙ্গটি তোলেন। বেতন কমিশনের বার বার মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বেতন কমিশন প্রসঙ্গে মমতা তীব্র আক্রমণ করে বলেন, “নির্বাচনের সময় নতুন পে কমিশনের ব্যাপারে অনেক কুত্সা ছড়ানো হচ্ছিল। অনেকেই বলছেন এটা দিন ওটা দিন। কিন্তু বেতন কমিশন রিপোর্ট দিলে তবেই তো কার্যকর করার প্রশ্ন আসবে। বেতন কমিশন রিপোর্টই পেশ করেনি এখনও। ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে তারা। ওরা রিপোর্ট জমা দিলে সাধ্যমতো যা করার করব।” এ নিয়ে তিনি কমিশনের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকারকে ডেকে কথা বলবেন বলেও জানান।
আরও পড়ুন: দিল্লির নজরে বাংলা, কেশরীর রিপোর্ট নিলেন মোদী, শাহ-ডোভাল বৈঠকেও হিংসা নিয়ে কথা
আরও পড়ুন: দলীয় কর্মীদের খুনের প্রতিবাদে বসিরহাট বন্ধে দফায় দফায় রেল, রাস্তা অবরোধ বিজেপির
তবে বেতন কমিশনের সুপারিশ মানতে গিয়ে রাজ্যের কল্যাণমূলক প্রকল্প যে তিনি বন্ধ করবেন না সেটাও এ দিন জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “বেতন কমিশন যদি সুপারিশ করে খাদ্যসাথী প্রকল্প বন্ধ করতে, তা কখনওই সম্ভব নয়। গরিব লোককে ভাতে মারব না। গরিব লোককে কাজ দেওয়াই আমার কাজ।” রাজ্যের মানুষের স্বার্থে চালু করা এই প্রল্পগুলোর সুবিধা যাতে মানুষ সঠিক ভাবে পান সে দিকটাও নজর রাখছে রাজ্য সরকার। এ ক্ষেত্রে কোনও অন্যায় বরদাস্ত করা হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। সেই সঙ্গে এ ব্যাপারে নজরদারি চালাতে জেলা ও স্থানীয় প্রশাসনগুলোকে নজর রাখার নির্দেশও দেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন। বিজেপি সমর্থিত সরকারী কর্মচারী পরিষদের আহ্বায়ক দেবাশীষ শীল জানিয়েছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ষষ্ঠ বেতন কমিশনের কাজে গতি আনার বিষয়ে যা বলেছেন তা তাঁদের কাছে গিমিক ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর কথায়, ‘‘এই রাজ্য সরকার বেতন কমিশনের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়ে ৪ বছর ১ মাস করেছে। যা এক কথায় সারা ভারতে নজীরবিহীন। তা ছাড়া সর্বশেষ আদেশ-বলে বেতন কমিশনের মেয়াদ ৩১ শে ডিসেম্বর ,২০১৯ অবধি করা হয়েছে। কাজেই এই পরিস্থিতিতে কমিশনের কাজের গতি বাড়ানোর কথা হাস্যকর বলেই মনে হয় আমাদের।’’
দেবাশীষবাবু আরও জানান, এ বারের লোকসভা নির্বাচনে সরকারী কর্মচারী, শিক্ষকদের পোস্টাল ব্যালটে প্রায় সব কেন্দ্রে বিজেপির পক্ষে বিপুল পরিমাণে জয়লাভ করার ঘটনায় কর্মচারী, শিক্ষকদের অসন্তোষকে প্রলেপ দেবার চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বঞ্চিত রাজ্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখ এ ভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে না। আমরা পূর্ব ঘোষিত জুলাই মাসের গোড়াতে বিকাশ ভবনে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের অপদার্থ চেয়ারম্যানকে ঘেরাও কর্মসূচি পালন করব।’’
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্যে তাঁরাও যে খুশি নন, তৃণমূলের সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের মেন্টর গ্রুপের আহ্বায়ক মনোজ চক্রবর্তীর কথাতেও তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘‘বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকারের কথার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মিলে গেল। অভিরূপ সরকারও বলেছিলেন, সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতার টাকায় উন্নয়নের কাজ চলছে। মুখ্যমন্ত্রী আজ যা বললেন, তার অর্থও একই। এর পরে বেতন কমিশনের কাছ থেকে ভাল কিছু আশা করব কী ভাবে?’’
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে সমর্থন করেনি রাজ্য কোঅর্ডিনেশন কমিটিও। সিপিএমের ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিজয়শঙ্কর সিংহ বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যে কথা বলছেন, সরকারি কর্মীরা সে কথা মানতে রাজি নন। আমাদের জানা ছিল না যে, আজই মুখ্যমন্ত্রী এই রকম একটা মন্তব্য করবেন। কিন্তু ওঁর ওই মন্তব্যের আগেই আমরা আজ বেতন কমিশনকে চিঠি দিয়েছি। ৪১ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা এবং অবিলম্বে বেতন কমিশনের সুপারিশ জমা দেওয়ার দাবি সে চিঠিতে জানিয়েছি। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে সমর্থন করার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করছি।’’
একই সুর শোনা গিয়েছে কংগ্রেসের সংগঠন কনফেডারেশনের মুখেও। আগামী দিনে তারা বৃহত্তর আন্দোলনে যাবে বলেও ঘোষণা করেছে। এ দিন সংগঠনের তরফে সুবীর সাহা বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আমাদের কথাকেই মান্যতা দিলেন যে, এই বেতন কমিশন অযোগ্য। মুখ্যমন্ত্রী বিভাজনমূলক নীতি নিয়ে চলছেন। নাগরিকদের একাংশকে সুবিধা দিতে নাগরিকদের আর একটা অংশকে বঞ্চিত করা হবে, এটা কোনও নীতি হতে পারে না। আগামী দিনে বৃহত্তর আন্দোলনে যাচ্ছি।’’