গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের মার্চ মাস— তিন বছরে পাঁচ বার জখম হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কখনও ঘটনাস্থল নন্দীগ্রাম, কখনও স্পেন, কখনও কলকাতা। কখনও আকাশপথে, কখনও সড়কপথে।
গত বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রামে প্রার্থী হয়েছিলেন মমতা। প্রচারে গিয়ে ২০২১ সালের ১১ মার্চ নন্দীগ্রামের বিরুলিয়া বাজারে গাড়ির দরজায় পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তৎক্ষণাৎ তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে এনে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কয়েক দিন সেখানেই চিকিৎসা চলেছিল তাঁর। বাঁ পায়ের গোড়ালিতে প্লাস্টার হয়েছিল তৃণমূলনেত্রীর। তার পর অবশ্য হুইলচেয়ারে বসেই নির্বাচনী প্রচার সেরেছিলেন মমতা। আর তৃণমূল স্লোগান দিয়েছিল, ‘ভাঙা পায়ে খেলা হবে।’
এর পর মমতা জখম হন গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে। ২৭ জুন জলপাইগুড়িতে সভা করে হেলিকপ্টারে বাগডোগরা বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কপ্টার আকাশে থাকতেই ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়। দুর্বিপাকে পড়ে মমতার কপ্টার জরুরি অবতরণ করে সেবকের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে। সেই সময়ে কোমরে আঘাত পান মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতায় ফিরে এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ভর্তি থাকতে হয়নি। বেশ কয়েক দিন বাড়িতেই চিকিৎসা চলে। করাতে হয় ফিজিয়োথেরাপিও।
তিন মাসের মধ্যে ফের আঘাত পান মুখ্যমন্ত্রী। গত বছর সেপ্টেম্বরে স্পেন ও দুবাই সফরে গিয়েছিলেন তিনি। মাদ্রিদে পুরনো আঘাতের জায়গায় নতুন করে চোট পান। স্পেন থেকে দুবাই হয়ে সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ কলকাতায় ফেরেন তিনি। তার পর ২৪ সেপ্টেম্বর এসএসকেএমে দেখাতে যান। হাসপাতালে দেখিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে সেই পর্বে এক মাসের বেশি তাঁকে গৃহবন্দি থাকতে হয়েছিল। পুজোর উদ্বোধনও বাড়ি থেকে ভার্চুয়ালি করেছিলেন মমতা। তিনি বাড়ি থেকে প্রথম বার হন রেড রোডে পুজো কার্নিভালের দিন। সেই সময়ে মমতা এ-ও জানিয়েছিলেন, তাঁর পায়ের ভুল চিকিৎসা হয়েছে এসএসকেএমে। তাঁকে ইন্টারভেনাস ফ্লুইড ইঞ্জেকশনও নিতে হয়েছিল।
তার পর মমতা আবারও জখম হন গত ২৪ জানুয়ারি। পূর্ব বর্ধমান থেকে গাড়িতে ফেরার সময়ে জখম। বর্ধমানের সভাস্থল থেকে গড়ানে পথে হাইওয়েতে উঠতে যাওয়ার সময়ই তাঁর গাড়ির সামনে অন্য গাড়ি চলে আসে। মুখ্যমন্ত্রীর চালক ব্রেক কষেন। সামনের আসনে বসা অবস্থায় মমতার কপাল ঠুকে গিয়েছিল শক্ত কিছুর সঙ্গে। সে বার অবশ্য তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়নি। কপালে ব্যান্ডেড লাগিয়ে সেই সন্ধ্যাতেই রাজভবনে গিয়েছিলেন মমতা। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘আজকে তো মরেই যেতাম। ২০০ স্পিডে একটা গাড়ি ঢুকে পড়েছিল। মাথাটা এখনও টনটন করছে।’’
তার পর গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। এ বার বাড়িতেই। যে ছবি দেখে শিউরে উঠেছিলেন অনেকেই। সন্ধ্যায় বাড়িতেই পড়ে গিয়েছিলেন মমতা। তাঁর কপালে গভীর ক্ষত হয়েছে। নাকেও চোট লেগেছে। সেই সময়ে তাঁর বাড়িতেই ছিলেন অভিষেক। উত্তরবঙ্গ সফর সেরে কালীঘাটে গিয়েছিলেন তিনি। অভিষেকই নিজের গাড়িতে মমতাকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যান। ক্ষতস্থানে চারটে সেলাই করে ড্রেসিং করে দেন চিকিৎসকেরা। উডবার্ন ওয়ার্ড থেকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে তাঁকে লাগোয়া বাঙুর নিউরোসায়েন্সেসের ওপিডি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার পর গাড়িতে করে আবার কালীঘাটের বাসভবনে ফিরে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, মুখ্যমন্ত্রী পিছন থেকে ধাক্কা লাগার কারণে পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কপালে তিনটি এবং নাকে একটি সেলাই করতে হয়েছে। এসএসকেএমের ডিরেক্টর মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় পরে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, পড়ে যাওয়ার সময়ে পিছন থেকে ধাক্কা লাগার অনুভূতি হয়েছিল মমতার। হাসপাতালে তাঁকে রাতে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু মমতা থাকতে চাননি। বাড়িতেই তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
এ তো গেল মমতার জখম হওয়ার ঘটনা। যার মধ্যে একাধিক ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু এ ছাড়াও আরও দু’টি ঘটনা মুখ্যমন্ত্রীর এবং তাঁর বাড়ির তল্লাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল। প্রথমটি ২০২২ সালের ২ জুলাই রাতের। জানাজানি হয়েছিল পরের দিন সকালে। মাঝরাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়েছিলেন এক ব্যক্তি। এমনকি সারা রাত বাড়ির মধ্যেই লুকিয়ে ছিলেন তিনি। সকালে তাঁকে আটক করে কালীঘাট থানার পুলিশ। জানা গিয়েছিল, বসিরহাটের বাসিন্দা সেই যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন।
এর পর গত বছর ২১ জুলাই মমতার বাড়ির কাছে ধরা পড়ে চন্দ্রকোণার বাসিন্দা মহম্মদ নুর আমিন নামের এক সশস্ত্র যুবক। পুলিশ জানিয়েছিল, কালীঘাট চত্বরে মমতার বাড়ির গলিতেই ধরা হয়েছিল তাঁকে। পুলিশের স্টিকার লাগানো গাড়ি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায় ঢোকার চেষ্টা করছিলেন তিনি। মাদকও ছিল যুবকের সঙ্গে। কালীঘাট থানার পুলিশ তাকে ধরে ফেলে।