নতুন বছরে গাড়ি শিল্পে কি বিপ্লব আসছে? মিশে যাবে দুই জাপানি সংস্থা? তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে দ্বীপরাষ্ট্রের আরও একটি নামী সংস্থা। সে ক্ষেত্রে জন্ম হবে বিক্রির নিরিখে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গাড়ি সংস্থার। এতে আর্থিক দিক থেকে ভারতের লাভ হতে চলেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
চলতি বছরের ২৩ ডিসেম্বর মউ সই করে জাপানের দুই গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা হোন্ডা এবং নিসান। এর মাধ্যমে সংযুক্তিকরণের রাস্তা খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে দুই বহুজাতিক সংস্থা। উল্লেখ্য, নিসানের সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি রয়েছে মিৎসুবিশি মোটরসের। জোটে শামিল হওয়ার আগ্রহ রয়েছে এই সংস্থারও।
সূত্রের খবর, আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) জুনের মধ্যে সংযুক্তিকরণ চুক্তি পুরোপুরি সেরে ফেলতে চাইছে নিসান এবং হোন্ডা। সে ক্ষেত্রে ২০২৬ সালের অগস্টের মধ্যে গাড়ি নির্মাণকারী একটি সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে তারা। আপাতত এর পরিচালনার দায়িত্ব হোন্ডার হাতে থাকবে বলে জানা গিয়েছে।
সূত্রের খবর, সব মিলিয়ে জাপানের তিন গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থার (হোন্ডা-নিসান-মিৎসুবিশি মোটরস) বাজারদর দাঁড়াচ্ছে ৫,৫০০ কোটি ডলারের বেশি। ফরাসি সংস্থা রেনোর সঙ্গে নিসানের চুক্তি রয়েছে। ফলে সংযুক্তিকরণ হলে এক ছাতার তলায় চলে আসবে দুনিয়ার অন্যতম সেরা চারটি গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা।
কিন্তু, কেন আলাদা অস্তিত্ব খুইয়ে মিশে যেতে চাইছে নিসান এবং হোন্ডা? এর নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকেরা। প্রথমত, গাড়ি বিক্রির নিরিখে প্রথম দু’য়ে রয়েছে জাপানি সংস্থা টয়োটা মোটরস এবং জার্মানির ফোক্সভাগেন। সংযুক্তিকরণ হলে তিন সংস্থা মিলে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে ফেলতে পারে এই দুই নামী সংস্থাকে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে কমছে প্রথাগত জ্বালানি (পেট্রল-ডিজ়েল) গাড়ির চাহিদা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিক্রি বাড়ছে হাইব্রিড বা বৈদ্যুতিক চার চাকার। সেখানে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে চিনের গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলি। বিওয়াইডি কো, এক্সপেঙ্গ, নিয়ো এবং লি অটোর মতো বেজিংয়ের ব্যাটারিচালিত গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলি প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলিকে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে দিচ্ছে।
তৃতীয়ত, সংযুক্তিকরণ সম্পন্ন হলে ব্র্যান্ডের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ভাগাভাগি করা সম্ভব হবে নিসান এবং হোন্ডার। দু’টি সংস্থা যৌথ ভাবে সফ্টঅয়্যার তৈরিতে জোর দিতে পারবে। তাদের পক্ষে আরও উন্নত বৈদ্যুতিক যান (ইলেকট্রিক্যাল ভেহিকল বা ইভি) নির্মাণ নিয়ে গবেষণা করা অনেক বেশি সহজ হবে।
বর্তমানে আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে নিসান। এ বছরের নভেম্বের প্রায় ন’হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছে এই জাপানি গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা। অর্থাৎ, মোট কর্মশক্তির ছ’শতাংশ হ্রাস করেছে তারা। গত ত্রৈমাসিকে ছ’কোটি ডলার লোকসান করেছে নিসান। এর পরই বিশ্বব্যাপী উৎপাদনের ২০ শতাংশ হ্রাস করে নিসান। ফলস্বরূপ কাজ হারান ওই কর্মীরা।
শেষ পর্যন্ত এই সংযুক্তিকরণ সম্পন্ন হলে দু’টি সংস্থাই লাভবান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইউরোপের বাজারে এখনও ভাল ভাবে পা জমিয়ে রেখেছে নিসান। অন্য দিকে হোন্ডার পাখির চোখ হল এশিয়ার ক্রেতারা। গাড়ির বাজারে দু’টি সংস্থার দু’ধরনের সুনাম রয়েছে।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, গাড়ির বডি বা বাইরের অংশ তৈরির ক্ষেত্রে নিসানের জুড়ি মেলা ভার। অন্য দিকে দুর্দান্ত ইঞ্জিন নির্মাণে সুনাম রয়েছে হোন্ডার। ব্যাটারিচালিত চার চাকার দুনিয়ায় হোন্ডার প্রবেশ ঘটেছে দেরিতে। আবার গত ১৫ বছর ধরে ইভি তৈরি করে চলেছে নিসান। যদিও বর্তমানে তাদের এই গাড়ির চাহিদা অনেক কমে গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সংযুক্তিকরণ চুক্তির ক্ষেত্রে চালকের আসনে রয়েছে হোন্ডা। নিসানের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর এই জাপানি সংস্থাই যৌথ হোল্ডিং কোম্পানির প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করবে। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত পরিচালকদের সংখ্যাগরিষ্ঠই হবেন হোন্ডার পদস্থ আধিকারিক বা কর্মী।
সংযুক্তিকরণের বিষয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন হোন্ডার সিইও তোশিহিহিরো। তাঁর কথায়, ‘‘গাড়ি নির্মাণশিল্পে বিশ্ব জুড়ে নাটকীয় পরিবর্তন চলছে। এই অবস্থায় নিসানের মতো সংস্থার সাহায্য ছাড়া আমাদের এগিয়ে যাওয়া একরকম অসম্ভব। একীকরণ সম্পন্ন হতে একাধিক সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার সুযোগ পাব আমরা।’’
প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে নিসানের সিইও উচিদা মাকোটোর গলায়। তিনি বলেছেন, ‘‘গাড়ি নির্মাণশিল্প সম্পূর্ণ নতুন যুগে পা দিতে চলেছে। আমরা সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এই অবস্থায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে একীকরণ গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হতে চলেছে। এতে আমাদের আরও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ থাকছে।’’
মিৎসুবিশি মোটরসের অধিকাংশ শেয়ার রয়েছে নিসানের হাতে। আর তাই সংযুক্তিকরণের আলোচনায় যোগ দিতে চাইছে এই জাপানি সংস্থাও। মিৎসুবিশি মোটরসের সিইও কাতো টাকা বলেছেন, ‘‘আমরা এই একীকরণকে স্বাগত জানাচ্ছি। অবিলম্বে এর অংশ হতে চাই।’’
ভারতের বাজারে নিসানের থেকে হোন্ডার গাড়ির জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। জাপানি সংস্থাটির সেডান মডেল ‘হোন্ডা সিটি’র দুর্দান্ত চাহিদা রয়েছে। সেডান মডেলের নিরিখে দীর্ঘ দিন প্রথম স্থান ধরে রেখেছিল হোন্ডা। পরবর্তী কালে দেশীয় সংস্থা মারুতি-সুজ়ুকি এবং টয়োটার কাছে হারতে হয় তাকে।
এ দেশের বাজারে প্রথম হাইব্রিড গাড়ি এনেছিল হোন্ডাই। কিন্তু, সেটি লম্বা সময়ের জন্য শীর্ষ স্থান ধরে রাখতে পারেনি। বর্তমানে সেখানেও উপরের দিকে রয়েছে মারুতি-সুজ়ুকি এবং টয়োটার নাম।
অন্য দিকে ছোট স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল বা এসইউভিতে মোটের উপর ভাল সাফল্য পেয়েছে নিসান। ভারতীয় ক্রেতাদের পছন্দমাফিক এই ধরনের একাধিক মডেল বাজারে আনতে অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট জাপানি সংস্থা।
নিসান ও হোন্ডার সংযুক্তির সরাসরি প্রভাব পড়বে শেয়ার বাজারে। দু’টি সংস্থার শেয়ারের দর হু হু করে বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি যৌথ মালিকানায় গাড়ির দাম কমাতে পারে তারা। সে ক্ষেত্রে গাড়ি বিক্রির সূচক উপরের দিকে উঠবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।