পুরকর্মীরা এক জায়গায় জড়ো করা জঞ্জালে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। প্রতীকী ছবি।
বাড়ি বাড়ি সংগ্রহ করে আনা বর্জ্য প্লাস্টিকে ভরে শুরু হয় মাপার কাজ। প্রতিদিন কত ওজন হল, জানাতে হয় স্থানীয় পুর প্রতিনিধিকে। জঞ্জাল নেওয়ার লরি এলে প্লাস্টিক ভর্তি বর্জ্য তুলে দিতে হয় তাতে। বহু দিনই দেখা যায়, বর্জ্যের ভারে লরিতে স্থানাভাব। মাঝেমধ্যেই পড়ে থাকে বর্জ্য ভর্তি কিছু প্লাস্টিক। জমতে জমতে এক সময়ে সেগুলির পাহাড় হয়। অভিযোগ, নির্দেশ মেনে ওই সব বর্জ্য ফাঁকা জায়গায় রেখে ভোরে বা রাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়!
কারা এই নির্দেশ দেন? কারা আগুন ধরান? ‘দূষণ-যজ্ঞ’ হয়ই বা কোথায়? অভিযোগ, সবটাই হয় শহরে, জনবসতির মধ্যে। সেই নির্দেশ আসে স্থানীয় পুর প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত, এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে। পুরোটা নিষিদ্ধ জেনেও পদক্ষেপ করেন না পুর প্রতিনিধিরা, অভিযোগ এমনটাই। পুলিশেরও কোনও হুঁশ থাকে না বলেই দাবি। সম্প্রতি বিধি উড়িয়ে বর্জ্য পোড়ানোর প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়েছিল ভারত চেম্বার অবকমার্সের একটি আলোচনায়। সেখানে ছিলেন কলকাতার নগরপাল বিনীত গোয়েল। সভায় উপস্থিত কেউ কেউ নগরপালকে জানান, ভোরে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে তাঁরা প্রায়ই দেখেন, পুরকর্মীরা এক জায়গায় জড়ো করা জঞ্জালে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। নগরপালের কাছে এ-ও অনুরোধ আসে, পুরকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ করুক। তিনি বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদেরও কোনও ভূমিকা দেখা যায় না বলে দাবি করেছেন অনেক অভিযোগকারী।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দাবি, জঞ্জাল থেকে নির্গত মিথেন গ্যাস বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২১ গুণ বেশি দায়ী। ফলে জঞ্জাল পোড়ানোর পরে বিপদ আরও কতটা বাড়ে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত বললেন, “এ জিনিস নতুন নয়। শহরে দূষণের মূল তিনটি কারণের একটি হল বর্জ্য থেকে দূষণ। সংগৃহীত জঞ্জালের ব্যবস্থা করতে না পেরে এক সময়ে কাউন্সিলর বা তাঁর দলই সে সব এক জায়গায় রেখে পুড়িয়ে ফেলতে বলেন। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। পুলিশও চুপ করে থাকে।” তাঁর আরও দাবি, ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১৬’ অনুযায়ী, তরল এবং কঠিন বর্জ্য আলাদা করার কথা। ধাপার মতো বর্জ্য জমানো নিষিদ্ধ। ‘স্যানিটারি ল্যান্ডফিল’ তৈরি করার কথা। সেগুলির কিছুই মানা হচ্ছে না।
সবুজ মঞ্চের আর এক পরিবেশকর্মীর দাবি, রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, ধাপায় ৬০ একর জায়গা জুড়ে স্তূপীকৃত বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ৪০ লক্ষ টন। ‘বায়োরেমিডিয়েশন’ প্রক্রিয়ায় যার মধ্যে দু’লক্ষ টনেরও কম পরিমাণ বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণ সম্ভব হয়েছে। অবশিষ্ট বিপুল বর্জ্য দীর্ঘ দিন ধরে বিস্তীর্ণ এলাকায় দূষণের কারণ হয়ে উঠেছে। একই উদাসীনতার চিত্র তরল বর্জ্যের ক্ষেত্রেও। কলকাতায় দৈনিক তরল বর্জ্য পরিশোধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। প্রতিদিন উৎপন্ন ১৪০ কোটি লিটার তরল বর্জ্যের মধ্যে ৯০ কোটি লিটারেরও বেশি বর্জ্য প্রাকৃতিক উপায়ে পরিশোধন করে এই জলাভূমি। অথচ, বেআইনি নির্মাণের কারণে ধীরে ধীরে বুজে যাচ্ছে প্রাকৃতিক এই পরিশোধন ক্ষেত্র।
এমন পরিস্থিতিতে লোকালয়ের মধ্যেই অতিরিক্ত বর্জ্য জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া রোখা যাবে কী ভাবে? সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিয়েছেনকলকাতার নগরপাল। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, “পুরকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ওঁরা হয়তো জানেন না, এটা থেকে দূষণ ছড়ায়।” পুরসভার মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল অপসারণ) দেবব্রত মজুমদার বলছেন, “পুরকর্মীরা এমনটা করতেই পারেন না। উল্টে তাঁরাই তো এমন করতে নিষেধ করেন। শীতের রাতে কেউ কেউ আগুন জ্বালিয়ে হাত-পা সেঁকতে এমনটা করে থাকেন। তবে শহরে পর্যাপ্তনৈশাবাস চালু হওয়ার পরে সেটাও কমে গিয়েছে। এর পরেও যদি অভিযোগ ওঠে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”