Kolkata Footpath

কলকাতার ফুটপাথে চেম্বার বসান হাওড়ার তপন, তিন দশক ধরে প্রেশার, সুগার মেপে দিচ্ছেন অফিসপাড়ায়

ফুটপাথে বসে তো আর ডাক্তারি করা যায় না। সেই বিদ্যেও নেই তপন দাসের। তবে তিনি হাতেকলমে প্রেসার আর সুগার মাপার কাজটা জানেন। সেই জ্ঞান নিয়েই চলে তাঁর ফুটপাথের চেম্বার।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৪ ১০:২২
Share:

কলকাতার ফুটপাথে বসে রক্তচাপ মাপছেন তপন দাস। —নিজস্ব চিত্র।

সময় বদলায়। পথও। তবে ফুটপাথ বদলান না তপন দাস। একটা সময়ে হাওড়া ময়দান থেকে বাসে করে বকুলতলায় নামতেন। তার পরে হেঁটে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট। এখন সময় বদলে দিয়েছে পথ। সেই হাওড়া ময়দান থেকেই গঙ্গার তলা দিয়ে তাঁকে মেট্রো নিয়ে আসে মহাকরণ স্টেশনে। পরের হাঁটাটা একই রয়েছে। যে ভাবে গত তিন দশক ধরে তাঁর ‘ফুটপাথের চেম্বার’ও একই রয়ে গিয়েছে। তবে তিনি ডাক্তার নন, ডাক্তারির কিছু জানেনও না। তবে হাতেকলমে নিখুঁত মাপতে জানেন রক্তচাপ। যন্ত্রের মাধ্যমে বলে দিতে পারেন রক্তে শর্করার মাত্রাও।

Advertisement

বাবা গোপাল দাস ছিলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী। চাকরিসূত্রে মেদিনীপুর থেকে এসে হাওড়া ময়দানের কাছে ভাড়া থাকতেন। তবে অভাবের কারণে একমাত্র পুত্র তপনকে সে ভাবে লেখাপড়া করাতে পারেননি। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া তপন ১৮-১৯ বছর বয়সে এক চিকিৎসকের সহকারীর কাজ পান। খুব বেশি দিন কাজ করেননি। তবে মাস ছয়েকের মধ্যে রোগীদের প্রেশার মাপা, ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা শিখে নিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল, কলকাতার পথে যদি মানুষের প্রেশার-সুগার মাপা যায়? কেমন হয়? ঘুরতে ঘুরতে অফিসপাড়ার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে চলে আসেন। কথা হয় স্থানীয় হকার ইউনিয়নের সঙ্গে। সেটা ১৯৯২ সাল। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তাঁর ফুটপাথের চেম্বার। বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা— ‘কেয়ার অফ ফুটপাথ’ ঠিকানা নিয়েই চলছে তপনের ব্যবসা।

ধর্মতলা থেকে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের দিকে যাওয়া বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের পাশ দিয়ে আসা আব্দুল হামিদ স্ট্রিট যেখানে মিশছে, সেখানেই তপনের ‘চেম্বার’। লাইন দিয়ে ওই রাস্তায় অনেকেই কাটা ফল, স্যান্ডুইচ, চা, চশমা সারাইয়ের পসরা নিয়ে বসেন। তার মাঝখানেই প্রেশার, সুগার মাপার টেবিল। তপনের চেম্বারকে ‘টেবিল’ বলাই ভাল। গায়ে ‘ব্লাড সুগার চেক, ব্লাড প্রেশার চেক’ লেখা বোর্ড। টেবিলের উপর পরীক্ষার যন্ত্রপাতি। পাশে একটি টুল আর দু’টি চেয়ার। টুলটি তপনের। যাঁরা পরীক্ষা করান তাঁদের জন্য চেয়ার। তপন বললেন, ‘‘৩২ বছর ধরে এ ভাবেই চলছে আমার কাজ। সকালে ঠিক ১০টায় খুলি আর সন্ধ্যা ৬টা বাজলে ছুটি।’’ তপন যেখানে বসেন, সেখানে একের পর এক পানশালা। তবে সে সব মদিরালয়ে সন্ধ্যার আলো জ্বলার আগেই যন্ত্রপাতি গুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন তপন।

Advertisement

কারা আসেন তাঁর কাছে সুগার, প্রেশার মাপাতে? তপন বলেন, ‘‘এখানে অনেক সরকারি, বেসরকারি দফতর রয়েছে। সেখানকার কর্মীরাই আমার গ্রাহক। জীবনবিমা থেকে আয়কর বিভাগ— সব অফিস থেকেই কর্মীরা আসেন। তবে আগের থেকে তাঁদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে।’’ শুধু অসুস্থ হলে আসেন তা নয়, নিজেদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার জন্যও অনেকে নিয়মিত আসেন। তবে গ্রাহক কমে যাওয়ার জন্য করোনাকালকে দায়ী করেন তিনি। বলেন, ‘‘করোনার সময়ে বেশ কয়েক মাস বসতে পারিনি। তখন অনেকেই বাড়িতে প্রেশার আর সুগার মাপার যন্ত্র কিনে নিয়েছেন। ফলে আমার গ্রাহক অনেক কমেছে।’’

এখন ২০ টাকায় প্রেশার আর ৫০ টাকায় সুগার মাপেন তপন। শুরুর সময়ে দর ছিল ২ টাকা আর ৫ টাকা। সেটা করেই সংসার চালিয়েছেন। ছেলেকে বড় করেছেন। এখন সেই ছেলেই তাঁর সহায়। বেসরকারি সংস্থায় চাকরি পেয়ে ছেলে শুভম বাবার পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে তাঁদের নিজস্ব ঠিকানা হয়েছে। ফলে বাজার পড়তি হলেও সংসার চালাতে অসুবিধা হয় না।

ফুটপাথের বাকি হকার বন্ধুদের মতো পুরসভার দেওয়া রঙিন ছাতা নিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার পসরা সাজালেও তপনের ছুটি একেবারে সরকারি বাবুদের মতো। সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার। পুজো থেকে অন্যান্য পরব, সরকারি ছুটি মানে তাঁরও ছুটি। খালি বছরের একটি দিন পুলিশ বসতে দেয় না। ফি বছর ২১ জুলাই। তৃণমূলের ধর্মতলার সমাবেশের দিন। সে দিন অবশ্য কোনও হকারকেই বসতে দেওয়া হয় না ওই এলাকায়।

সে সব দিন বাদ দিলে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটেই দেখা মিলবে হাওড়ার তপনের। ওষুধ খেতে বলেন না কাউকে। তবে প্রেশার আর সুগার মাপার পর ‘খারাপ’ ইঙ্গিত পেলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে বলেন। পরে খোঁজ নেন কে কেমন আছেন। নিয়মিত মেপে যেতে বলেন সুগার, প্রেশার। তবেই না তাঁর গ্রাহকেরা নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। তপনেরও সংসার চলবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement