১৪ অগস্ট রাত দখলের মঞ্চে রিমঝিম। —ফাইল চিত্র।
মুখগুলি কোথায় গেল? সাংগঠনিক রাজনীতিকে ‘অস্বস্তিতে’ ফেলে যে ‘অভূতপূর্ব’ নাগরিক আন্দোলন চমকে দিয়েছিল মাত্র দু’মাস আগে, তা কোথায়? স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচি দিয়ে যার শুরু? কলকাতা থেকে জেলা, ছোট শহর থেকে মফস্সল— আলোড়িত হয়েছিল বাংলা। সেই কর্মসূচির ‘প্রথম’ ডাকটি ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী রিমঝিম সিংহের। কোথায় সেই রিমঝিম? কোথায় সেই সব আনকোরা মুখের , যাঁরা আগে কোনও দিন মিছিলে হাঁটেননি, স্লোগান তোলেননি, হঠাৎই একটা সংঘবদ্ধ স্বরের মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন স্রেফ এক-এক জন নাগরিক হিসেবে? প্রতিবাদী হিসেবে? কোথায় তাঁরা?
ফোন করতেই ‘সিংহ’ রিমঝিম যেমন জানিয়ে দিলেন, তিনি আছেন। তবে গুছোচ্ছেন। কী গুছোচ্ছেন? সংগঠন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি এখন দালান গুছোচ্ছি। ঘর নয়। দালান। ঘর বললে বিষয়টি কেমন ছোট হয়ে যায়। তাই দালান বলছি।’’
১৪ অগস্ট রাতে মেয়েদের রাত দখল-এর আয়োজন বা প্রচারের দিকে যাঁরা চোখ রেখেছিলেন সাগ্রহে, তাঁদের অনেকেরই নজর এড়ায়নি এর ‘উপরতলার’ মধ্যেকার মতবৈচিত্র এবং মতভেদের মধ্যে সুপ্ত হয়ে থাকা ভাঙনের ভ্রূণ। সেই রাতের অব্যবহিত পর থেকেই নতুন নতুন নামে বহুবিধ কর্মসূচি রাস্তায় আছড়ে পড়তে থাকে। ‘রাত দখল অধিকার দখল’, ‘পথের দাবি’, ‘পথ দখলের ডাক’, ‘তিলোত্তমার পাশে ময়দান’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ তো ছিলই। নানা ‘ব্যানার’-এর পিছনে ভিড় কম ছিল না ‘অরাজনৈতিক’ নাগরিক সমাজেরও। তবে অসংগঠিত আন্দোলনের মধ্যে তিরতির করে বইতে থাকা নানা ধরনের সংগঠিত চলনের উপস্থিতিও ছিল প্রথম দিন থেকেই।
মেয়েরা, রাত দখল করো। স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে যাদবপুর। —ফাইল চিত্র।
পরবর্তী সময়ে ৪ সেপ্টেম্বরও অনেক জায়গায় রাত দখল হয়েছিল। কিন্তু তা ১৪ অগস্টকে ছুঁতে পারেনি। সংগঠকেরা মানছেন, এখন গোটাটাই কলকাতা কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চ কেন্দ্রিক। গত ১৫ অক্টোবর ধর্মতলায় ‘দ্রোহের কার্নিভাল’-এ নাগরিক সমাজ ছিল মূলত ম্লান। সংগঠিত শক্তিরই অনেক বেশি উপস্থিতি ছিল সে দিন। নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক উর্বা চৌধুরী অবশ্য মনে করেন না যে, আন্দোলন স্তিমিত হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও আন্দোলন কর্মসূচিই স্তিমিত হচ্ছে বলে হুট করে দাবি করা যায় না। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান যেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক, তেমন কর্মসূচির ধরন ও সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়া কেমন হলে সবচেয়ে কার্যকরী হয়, সেটা স্থির করতে হয়।’’ উর্বার কথায়, ‘‘আড়াই মাস ধরে প্রতি দিন নানা মানুষ একটাই লক্ষ্যে একাধিক প্রতিবাদ কর্মসূচি নিতেও পিছপা হচ্ছেন না, তথাকথিত জমায়েত কেমন হবে তা নিয়ে ভাবছেন না, লক্ষ্যে অটল থাকছেন। এ রকম নির্ভীক মূল্যবোধের আস্ত একটা সমাজজীবন আটপৌরে পশ্চিমবঙ্গ আগে দেখেছে? আন্দোলন চলবে, এর ব্যত্যয় হবে না।’’
রিমঝিম অবশ্য মনে করেন আরজি কর নিয়ে নাগরিক আন্দোলন ‘স্তিমিত’ হয়েছে। সে কারণেই বিষয়টিকে এ বার সংগঠিত রূপ দেওয়ার প্রয়াস নিচ্ছেন তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা। রিমঝিমের কথায়, ‘‘হুজুগে অনেক মানুষ শুরুতে নেমেছিলেন। কিন্তু এক মাস যেতেই দেখা যায়, আন্দোলনের সংখ্যা কমছে। তাই আমাদের মনে হয়েছে, রোজ রাত দখল বা মিটিং-মিছিল করে হবে না। দাবিগুলি নিয়ে যথাযথ দিশা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যেই পথ চলছি আমরা।’’ ১৪ অগস্ট কি তা হলে হুজুগ ছিল? রিমঝিমের জবাব, ‘‘সেটা ছিল অনেক দিনের জমে থাকা রাগের আস্ফালন।’’
৪ সেপ্টেম্বর। রাত দখলের সমাবেশ আরজি কর হাসপাতালের সামনে। —ফাইল চিত্র।
আরজি করের ঘটনার পরে যে ভাবে শান্তিপূর্ণ গণক্ষোভ রাস্তায় আছড়ে পড়েছিল, তাকে অনেকেই নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং করছেন। অনেকেই মনে করেন, বিভিন্ন কারণে শাসকদের উপর রাগের বারুদের স্তূপে আরজি কর একটি জ্বলন্ত দেশলাই কাঠির কাজ করেছিল। রিমঝিমও খানিকটা সেই আঙ্গিকেই ব্যাখ্যা করছেন নাগরিক আন্দোলনকে। মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচি যে দিন প্রথম হল, সেই সময় আরজি করের ঘটনা ছিল টাটকা। মাত্র পাঁচ দিনের।
রিমঝিমের বক্তব্য, তাঁরা চেয়েছিলেন নাগরিক আন্দোলন স্বাধীন ভাবে চলুক। চেয়েছিলেন, সংসদীয় রাজনীতিতে রয়েছে এমন দলগুলি তাতে যেন না থাকে। আরজি কর আন্দোলন ৭০দিন পার করার পরে রিমঝিমের মনে হচ্ছে, ‘‘অনেক সময়েই সংসদীয় রাজনীতির ছোঁয়ায় থাকা বিভিন্ন দল আন্দোলনকে দখল করার চেষ্টা করেছে।’’ সেই প্রেক্ষাপটেই তাঁরা চাইছেন আরও বেশি করে দাবিগুলিকে সুসংহত করতে। আন্দোলন যাতে কলকাতা থেকে জেলায় ছড়িয়ে পড়ে, নতুন করে মাথা তোলে, তারই অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি সারছেন। সার্বিক দাবির সঙ্গে স্থানীয় দাবিকেও জু়ড়তে চাইছেন তাঁরা।
স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ যেমন দ্রুত তৈরি হয়, দ্রুত মিলিয়েও যায়। বাংলা জুড়ে তৈরি হওয়া ১৪ অগস্টের ‘জাগরণ’-এর দু’মাস পরের পরিস্থিতি নিয়ে এমনটাই ব্যাখ্যা অনেকের। অনেকে মনে করছেন, এই মুহূর্তে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনই নানা ভাবে শাসক-বিরোধী মেজাজকে ধরে রেখেছে। এবং নাগরিক সমাজের একটা অংশের সমর্থন এর পিছনে রয়েছে। তবে একই সঙ্গে অনেকে এ-ও মনে করছেন, শাসকের প্রতি ক্ষোভটা ‘ঘুসঘুসে জ্বরের মতো’ নাগরিক সমাজে রয়ে গেল। আবার আরজি করের মতো কোনও একটা ঘটনায় অগস্ট-বহিঃপ্রকাশ হতেই পারে। গোটা নাগরিক আন্দোলনের পর্বে উল্লেখযোগ্য ভাবে একেবারে সামনের সারিতে দেখা গিয়েছে মেয়েদের। মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার পর গণ আন্দোলনে মেয়েদের এই ‘অগ্রণী’ হয়ে ওঠাটাও বাংলার মাটিতে নতুন ছবি ছিল।
১৫ অক্টোবর। ধর্মতলায় দ্রোহের কার্নিভাল। —ফাইল চিত্র।
মেয়েদের এই ভূমিকাকেই আরও প্রসারিত করতে, আরও তৃণমূল স্তরে নিয়ে যেতে চাইছেন ‘রাত দখল’ আন্দোলনের নারী সংগঠকদের কেউ কেউ। এঁরা কেউ রাজনৈতিক কর্মী, কেউ সমাজকর্মী, কেউ বা দুটোই। ছোট ছোট ‘রাতের মিটিং’ শুরু করেছেন মুনমুন-প্রিয়স্মিতারা। দু’জনেই ‘রাত দখল, অধিকার দখল’ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক। প্রিয়স্মিতার কথায়, ‘‘আমরা একটা মন্থন চাইছি। মেয়েরা মেয়েদের কথা খুলে বলবেন। নানা মেয়ের নানা সমস্যার কথায় আমরা পরস্পরকে আরও ভাল ভাবে বুঝতে পারব। এর মধ্যে দিয়ে নতুন দাবিও উঠে আসতে পারে। এই কাজটা বড় আকারের জমায়েতে বা সমাবেশে নয়, ছোট আকারের সভায় বা মিটিংয়েই সম্ভব।’’ ইতিমধ্যেই কলকাতার রাস্তায় একাধিক ‘রাতের মিটিং’ করেছেন ওঁরা। ভবিষ্যতে গ্রাম-মফস্সলেও কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা। প্রিয়স্মিতারা চাইছেন, শুধু মেয়েরাই নন, প্রান্তিক লিঙ্গ বা যৌনতার মানুষেরাও এর মধ্যে এগিয়ে আসুন, তাঁদের সমস্যার কথা তুলে ধরুন।