বৃহস্পতিবার ভোরে তিলজলার এক জুতোর প্রিন্টিং কারখানায় আগুন লেগে সেখানে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতীকী ছবি।
আগুন লাগার কারণ কী? যে কোনও অগ্নিকাণ্ডের পরেই এই প্রশ্নটা অবধারিত ভাবে ঘুরপাক খায় নানা মহলে। দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল, বড়বাজারের বাণিজ্যিক বহুতল, পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট অথবা সার্কুলার রোডের হোটেল— সব ক্ষেত্রেই এর পরে সামনে আসে আগুন লাগার নির্দিষ্ট কিছু কারণ। কিন্তু তার মধ্যে আরও একটি বড় কারণ প্রতি বারই ধামাচাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। আর সেটি হল, দুর্নীতি। কারণ, কোনও বাণিজ্যিক কেন্দ্র চালানোর জন্য যে অগ্নিবিধি মানার কথা, তা মানা হয় না প্রায় কোথাওই। নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা দেখারও লোক থাকে না। লাইসেন্স দেওয়ার সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের চোখেই পড়ে না বেআইনি নির্মাণ থেকে অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থার অভাব, আপৎকালীন নিষ্ক্রমণ-পথের নামে নির্মম ঠাট্টা থেকে জমে থাকা দাহ্য পদার্থের পাহাড়। অভিযোগ, নেতা-দাদার আশীর্বাদ আর কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে ‘কাজ’হয়ে যায়!
কিন্তু কী করে এমনটা চলতে থাকে বছরের পর বছর? এই প্রশ্ন উঠেছে বৃহস্পতিবার ভোরে তিলজলার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়। জুতোর প্রিন্টিং কারখানায় আগুন লেগে ওই দিন সেখানে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও এক। সেখানে কোনও রকম অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না বলে অভিযোগ। গত মঙ্গলবার গড়িয়ার ব্রহ্মপুরের ঘিঞ্জি এলাকাতেও একটি কাঠেরকারখানায় অগ্নিকাণ্ডেও এই একই প্রশ্ন ওঠে। সেখানে আশপাশের দু’টিবহুতল এবং একটি নির্মীয়মাণ বহুতলে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। অথচ, সেখানেও কোনও অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা, ফায়ার লাইসেন্সের বালাই ছিল না। ঘটনাস্থলে পৌঁছনো রাজ্যের দুই মন্ত্রী দাবি করেন, ‘‘এখন গাফিলতি খোঁজার সময় নয়। আগে আগুন নেভানো দরকার।’’ কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, এই সব গাফিলতি থেকে কি আদৌ শিক্ষা নেওয়া হবে?
বাগড়ি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে কলকাতা পুরসভা ঠিক করেছিল, যে সব বাজারে পর্যাপ্ত অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা নেই, সেখানে আর ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হবে না। হবে না ট্রেড লাইসেন্স নবীকরণও। কিন্তু সেই সময়েএমন সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়িত করা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ, তার মাস দুয়েক আগেই শহরের ৩৭টি চিহ্নিত বিপজ্জনক ওঅগ্নিকাণ্ড-প্রবণ ভবনে ব্যবসার ছাড়পত্র দিয়েছিল পুরসভা। এর পরে ব্যাপারটি আটকে থাকে কিছু বাজার পরিদর্শন এবং পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে। প্রশ্ন ওঠে, শহরে বাজার এলাকার বাইরে যে হাজার হাজার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চলে, সেখানে কী ভাবে নজরদারি করা হবে? এ বিষয়ে দমকল দফতরকেই বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে বলে প্রশাসনিক স্তরে সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু বাস্তবে কার্যত হিমশিম খাচ্ছে দমকল দফতর। ছোট কারখানা না ধরেই শহর জুড়ে হোটেল, হাসপাতাল, নার্সিংহোম, শপিং মল, সিনেমা হল, বহুতল মিলিয়ে সংখ্যা প্রায় ছ’হাজারের আশপাশে। প্রতিটির ক্ষেত্রেই বছরে এক বার করে দমকলের লাইসেন্স নবীকরণ করাতে হয়। অর্থাৎ, অঙ্কের হিসাবে প্রতি বছর সেই ছ’হাজার আবেদন খাতায়-কলমে দমকল দফতরে জমা পড়ার কথা। মানে, প্রতি মাসে গড়ে ৫০০টি আবেদন। নিয়ম বলছে, দমকলের ‘প্রিভেন্টিভ’ বিভাগের আধিকারিকেরা সরেজমিনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বাড়ির অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলে তবেই লাইসেন্স নবীকরণ হবে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সত্যিই কি আধিকারিকেরা সব জায়গায় যান? দমকল দফতরের এক আধিকারিক বললেন, ‘‘অসম্ভব ব্যাপার। এই বিভাগে যত আধিকারিক রয়েছেন, তাতে প্রতি মাসে ২০০টি আবেদন দেখাই সম্ভব নয়। তার পরে শিলিগুড়ি, বর্ধমান-সহ রাজ্যের নানা জেলায় ছুটতে হয়।’’
তা হলে উপায়? শহরের অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থাকা একটি বাজারের এক ব্যবসায়ীর মন্তব্য, ‘‘অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা থাক বা না-ই থাক, কোনও ভাবে এ দিক-ও দিক করে কিছু ছবি দেখাতে পারলেই হল। তা ছাড়া, আধিকারিকদের খুশি করতে পারলেই আর সমস্যা থাকে না।’’
দমকল দফতরের ডিজি রণবীর কুমার যদিও বললেন, ‘‘সমস্ত স্তরেই পর্যাপ্ত লোক আছে। সমস্যার ব্যাপার নেই। লাইসেন্স ছাড়া যে সমস্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চলছে, সেগুলির ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’