প্রতীকী ছবি।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক পড়ুয়া। অবসাদ আর উৎকণ্ঠায় ভুগতে ভুগতে হঠাৎ করেই বাইরের জগৎ ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছিল সে। লেখার গতি কমে গিয়েছিল তার। যা প্রভাব ফেলছিল পড়াশোনায়।
পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার, বছর বাইশের এক তরুণী কাজ করতে করতে হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। ভুলে যাচ্ছিলেন অনেক কিছু। যা প্রভাব ফেলছিল তাঁর আত্মবিশ্বাসে। ক্ষতি হচ্ছিল কাজের। একই ভাবে চতুর্থ শ্রেণির এক পড়ুয়ার অভিভাবকেরা জানান, ছেলে খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। স্কুলেও পিছিয়ে পড়ছে সে।
তিনটি ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ পেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছিলেন গ্রাফো-থেরাপিস্ট মোহন বসু। কারণ, বেশ কয়েক বছর ধরেই বিদেশের কিছু সমীক্ষার রিপোর্ট ও গবেষণাপত্র পড়ে তাঁর মনে হয়েছিল, ওই তিন জনের শরীরেই ভিটামিন ডি থ্রি-র অভাব রয়েছে। তাঁর ধারণা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ তিনি পান কয়েক দিনের মধ্যেই। ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রত্যেকের শরীরেই ভিটামিন ডি থ্রি-র অভাব ধরা পড়ে। এর পরে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার দু’-তিন মাসের মাথায় ফের ওই রোগীরা তাঁর কাছে থেরাপি নিতে আসেন। মোহনবাবুর কথায়, ‘‘তিন জনই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসাদ কাটিয়ে উঠেছেন! ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে!’’
কিন্তু ভিটামিন ডি থ্রি-র সঙ্গে অবসাদ বা একাকিত্বের কী যোগ? মোহনবাবুর বক্তব্য, ‘‘ভিটামিন ডি থ্রি-র অভাবে শরীরে সেরোটোনিন হরমোনের ক্ষরণ ঠিকমতো হয় না। সেই হরমোনই মানুষের প্রাণোচ্ছ্বলতার প্রধান উৎস।’’ তাঁর দাবি, ‘‘শুধু অবসাদ নয়, আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে, এমন অনেকেরই গ্রাফো-থেরাপি করতে গিয়ে দেখি, ভিটামিন ডি থ্রি-র মাত্রা অস্বাভাবিক রকমের কম। থেরাপির পাশাপাশি সাপ্লিমেন্ট দিয়ে তাঁদের সুস্থ করে তোলা হয়েছে।’’
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দাবির কি আদৌ কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে?
মোহনবাবু জানান, বেশ কয়েক বছর ধরেই আমেরিকার কিছু চিকিৎসক-গবেষক তাঁদের লেখায় দাবি করছেন, ভিটামিন ডি থ্রি-র অভাবে মানবদেহে বাসা বাঁধছে ক্যানসার থেকে শুরু করে ডায়াবিটিসের মতো নানা রোগ। বাড়ছে স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টরেলের মাত্রাও। এর সঙ্গে অবসাদ ও আত্মহত্যাপ্রবণতারও যোগ রয়েছে বলে তাঁদের দাবি। ওই গবেষকদের আরও দাবি, এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের শরীরেই ভিটামিন ডি থ্রি-র অভাব অতিমাত্রায় রয়েছে! মোহনবাবু জানাচ্ছেন, মার্কিন মনোবিদ ও গবেষক ড্যানিয়েল গ্রেগরি আমেনের লেখা বই ‘মেমরি রেসকিউ’-তে বলা হয়েছে, ভিটামিন ডি-র অভাব মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলতে পারে। কোনও কোনও গবেষণায় আবার বলা হচ্ছে, শরীরে ভিটামিন ডি-র মাত্রা বেশি থাকলে তাঁদের অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কম থাকে।
মোহনবাবুর কথায়, ‘‘লেখাগুলিতে যা পড়েছি, তার সঙ্গে থেরাপি করাতে আসা রোগীদের লক্ষণ মিলে যাওয়াতেই আমি ভিটামিন ডি পরীক্ষা করাতে বলি। তাতে ফলও পাই।’’ যদিও মোহনবাবুর এই দাবি মানতে নারাজ অধিকাংশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞই। বরং অনেকেরই দাবি, অবসাদের পিছনে ভিটামিন বি ১ ও বি ১২-র অভাবের বিষয়টি প্রমাণিত। তবে ভিটামিন ডি-র ভূমিকার তেমন প্রমাণ মেলেনি।’’
মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেলের কথায়, ‘‘ভিটামিন ডি-র ঘাটতির সঙ্গে অবসাদ বা স্মৃতিশক্তি হ্রাসের যোগ নেই।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘শহরে বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষেরই ভিটামিন ডি-র ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। সেই তালিকায় অবসাদে ভোগা বা মানসিক ভাবে অসুস্থরাও আছেন। কিন্তু কখনওই ভিটামিন ডি-র ঘাটতি অবসাদের কারণ নয়।’’
আর এক মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের কথায়, ‘‘বর্তমানে অনেকেরই শরীরে ভিটামিন ডি কম। কিন্তু তার সঙ্গে অবসাদের কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা কিন্তু বিজ্ঞান এখনও প্রমাণ করতে পারেনি। ’’ যদিও প্রথমা চৌধুরীর মতো আর এক মনোরোগ চিকিৎসক একটু অন্য কথাই শোনালেন। তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি বেশ কিছু গবেষণায় কিন্তু ভিটামিন ডি-র মাত্রা কম থাকার সঙ্গে অবসাদের যোগের বিষয়টি উঠে এসেছে।’’ তবে তাঁর মতে, এ বিষয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।