Tigress Zeenat

বিকেল ৩টে ৫৮, শেষ হল ৩৬ ঘণ্টার ‘শেষ যুদ্ধ’! কী কৌশলে বাঘিনি জ়িনতকে ঘায়েল করলেন বনকর্মীরা

শনিবার ভোরে ডেরা এবং জেলা বদলে বাঁকুড়ায় ঢোকার পর বাঘিনিকে ধরার চেষ্টা করছিলেন বন দফতরের কর্মীরা। ৩৬ ঘণ্টা পরে বেপরোয়া জ়িনত বাগে আসায় অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তাঁরা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:৩৯
Share:

ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে বাঘিনি জ়িনতকে কাবু করার পরে। রবিবার বাঁকুড়ায়। —নিজস্ব চিত্র।

গত ন’দিন ধরে যে বাঘিনি তিন জেলা দাপিয়ে কার্যত নাকানিচোবানি খাইয়েছিল বন দফতরকে, সেই বাঘিনিই রবিবার বাঁকুড়ার গোঁসাইডিহির জঙ্গলে ধরা পড়ল অনায়াসে। বন দফতর পরিকল্পনা বদল করাতেই সাফল্য এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। পরিকল্পনা সফল হওয়ায় ৩৬ ঘণ্টার ‘শেষ যুদ্ধ’ সফল হল। শনিবার ভোরে ডেরা এবং জেলা বদলে বাঁকুড়ায় ঢোকার পর থেকে বাঘিনিকে ধরার চেষ্টা করছিলেন বন দফতরের কর্মী এবং আধিকারিকেরা। বেপরোয়া বাঘিনি বাগে আসায় অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তাঁরা।

Advertisement

ন’দিন আগে ঝাড়খণ্ডের কুলিয়া রেঞ্জের রাজাবাসার জঙ্গল পেরিয়ে চিয়াবান্ধি এলাকা হয়ে ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি থানার কাটুচুয়া জঙ্গলে প্রবেশ করেছিল বাঘিনি জিনাত। তার পর দু’দিন ধরে কখনও ময়ূরঝর্ণার জঙ্গলে, আবার কখনও কাকড়াঝোড় জঙ্গলে নিজের ঠিকানা বদল করছিল সে। পরে তেলিঘানার জঙ্গল হয়ে জ়িনত প্রবেশ করে পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানা এলাকার রাইকা পাহাড়ে। রাইকা পাহাড় ও পার্শ্ববর্তী ভাঁড়ারি পাহাড়ে দিন চারেক কাটিয়ে মানবাজারের ডাঙ্গরডিহির জঙ্গলে হাজির হয় সে। সেখান থেকেই শুক্রবার ভোরের দিকে জ়িনত কুমারী নদী পেরিয়ে ঢুকে পড়ে বাঁকুড়ার রানিবাঁধ ব্লকের গোঁসাইডিহির জঙ্গলে। বন দফতরের লাগাতার চেষ্টায় রবিবার সন্ধ্যার মুখে সেখানেই ধরা দেয় বাঘিনি।

দীর্ঘ ন’দিন ধরে বন দফতরের সঙ্গে চলেছে বাঘিনির লুকোচুরি খেলা। সূত্রের খবর, ঝাড়গ্রাম জেলায় থাকার সময় সে ভাবে বাঘিনিকে ধরার চেষ্টা করেনি বন দফতর। শুধুমাত্র তার গতিবিধির উপর নজর রাখা হচ্ছিল। বন দফতরের আশা ছিল বাঘিনি স্বেচ্ছায় ফিরে যাবে ওড়িশার সিমলিপালের পুরনো ঠিকানায়। কিন্তু বন দফতরের সেই আশায় জল ঢেলে পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের দিকে চলে যায় বাঘিনি। ফলে পরিকল্পনা বদল করে তাকে খাঁচাবন্দি করার কৌশল নেয় বন দফতর। রাইকা পাহাড়, ভাঁড়ারি পাহাড়ে বিভিন্ন সময় ছাগল ও মোষকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে জ়িনতকে ধরার চেষ্টা চালায় বন দফতর। কিন্তু লোভনীয় খাবারে রুচি না-দেখিয়ে নিজেই শিকার ধরে খেতে থাকে জ়িনত। যাবতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় বন দফতরের আধিকারিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ চওড়া হতে শুরু করে।

Advertisement

শুক্রবার থেকে বাঘিনি পাহাড়ি জঙ্গল ছেড়ে অপেক্ষাকৃত লোকালয় লাগোয়া জঙ্গলে আশ্রয় নিতে শুরু করায় চিন্তা আরও বৃদ্ধি পায় বন দফতরের। তার পরেই বাঘিনিকে খাঁচাবন্দি করার কৌশল বদলে ঘুমপাড়ানি গুলি ছু়ড়ে তাকে ধরার কৌশল নেয় বন দফতর। তবে সে কাজেও ধূর্ত বাঘিনিকে বাগে আনতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়। শনিবার বাঁকুড়ার গোঁসাইডিহির জঙ্গলে দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে নাইলনের জালের ঘেরাটোপে তিন বার ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়েও কাবু করা যায়নি তাকে। ঘুমপাড়ানি গুলি শরীরে লাগার পর প্রাথমিক ভাবে ঝিমুনিভাব এলেও কিছু ক্ষণ পরেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে জ়িনত। আবার জঙ্গলেই কোথাও লুকিয়ে পড়ছিল সে। ফলে শনিবারও অধরা থেকে যায় ওই বাঘিনি। এর পর গোটা জঙ্গল ঘিরে ফেলে জায়গায় জায়গায় আগুন লাগিয়ে তাকে খাঁচাবন্দি করার কৌশল নেওয়া হয়।

রবিবার আবার কৌশল বদল করে বন দফতর। সকালে বাঘিনিকে আরও কাছ থেকে সঠিক নিশানায় ঘুমপাড়ানি গুলি ছোড়ার সিদ্ধান্ত নেয় বন দফতর। গোঁসাইডিহি গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে জাল পেতে জ়িনতের গতিবিধি আরও ছোট এলাকায় সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। দুপুর ঠিক ৩টে ৫৮ মিনিটে বিশেষজ্ঞ দল জঙ্গলের ঘেরা অংশে প্রবেশ করে অত্যন্ত কাছ থেকে জ়িনতের শরীরের নির্দিষ্ট স্থান লক্ষ্য করে ঘুমপাড়ানি গুলি ছোড়ে। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে শিথিল হয়ে পড়ে জ়িনতের শরীর। এ বার আর অপেক্ষা না-করে তড়িঘড়ি কাবু হয়ে পড়া বাঘিনিকে ওড়িশার সিমলিপাল থেকে আনা বিশেষ খাঁচায় বন্দি করে ফেলে বন দফতর। রাজ্যের মুখ্য বনপাল (কেন্দ্রীয় চক্র) এস কুলানডাইভেল বলেন, “বাঘিনি ধরা পড়ার পর সুস্থ রয়েছে। বিষ্ণুপুর বন বিভাগের দফতরে নিয়ে গিয়ে বাঘিনির একদফা শারীরিক পরীক্ষা করানো হয়েছে। আপাতত তাকে পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আলিপুর চিড়িয়াখানায়।”

বাঘিনি ধরা পড়ার পরেই সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে বন দফতরের আধিকারিকদের এবং জেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং এলাকার বাসিন্দাদের অভিনন্দন জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, “আপনাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা শুধুমাত্র এক প্রাণীকেই রক্ষা করেনি, আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার গুরুত্বকেও শক্তিশালী করেছে। আপনাদের এই অসামান্য কাজের জন্য আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ!”

গত ১৫ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে তিন বছরের জ়িনতকে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে (টাইগার রিজ়ার্ভ, সংক্ষেপে বা এসটিআর) আনা হয়েছিল। কয়েক দিন ঘেরাটোপে রেখে পর্যবেক্ষণের পরে রেডিয়ো কলার পরিয়ে ২৪ নভেম্বর তাকে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে ছাড়া হয়েছিল। তার পরেই ঝাড়খণ্ডের দিকে হাঁটা দেয় জ়িনত। সেখান থেকে প্রায় সাত দিন ধরে রাজ্যের তিন জেলায় ঘুরে বেড়িয়ে অবশেষে ধরা দিল সে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement