রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। —ফাইল চিত্র।
শ্বাসকষ্টজনিত কারণে শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। তার পর ২৪ ঘণ্টার বেশি কেটে গিয়েছে। এখনও বিপন্মুক্ত নন রাজ্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার রাত পর্যন্ত তেমনই খবর হাসপাতাল সূত্রে। রবিবার সন্ধ্যায় আলিপুরের বেসরকারি হাসপাতালটি বুলেটিন প্রকাশ করে জানিয়েছে, এখনও ভেন্টিলেশনেই রয়েছেন বুদ্ধদেব। শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলেও সঙ্কটজনকই রয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
পরিবার সূত্রে খবর, কয়েক দিন ধরেই জ্বর ছিল বুদ্ধদেবের। এমনিতে তিনি সিওপিডি-তে আক্রান্ত। শুক্রবার থেকে শ্বাসকষ্ট বাড়তে বাড়়তে শনিবার সকাল থেকেই ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকেন তিনি। এর পরেই ওই দিন বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ বুদ্ধদেবকে তাঁর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে আলিপুরের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক ভাবে জানা যায়, বুদ্ধদেবের দু’টি ফুসফুসেই নিউমোনিয়ার সংক্রমণ ছড়িয়েছে। পরে রক্ত পরীক্ষাতেও দেখা যায়, কয়েকটি মাপকাঠিতে গোলমাল রয়েছে। হৃদ্যন্ত্রেও কিছু সমস্যা দেখা গিয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তির সময় শরীরে সামান্য তাপমাত্রা থাকলেও, পরে অবশ্য তা ছিল না। হাসপাতালের মেডিক্যাল বুলেটিনেও জানানো হয়েছিল, শ্বাসনালীতে সংক্রমণ রয়েছে ৭৯ বছরের রাজনীতিকের। এবং ‘টাইপ-২ রেসপিরেটরি ফেলিওর’ হয়েছে। ভর্তির পরেই মেডিক্যাল বোর্ড গড়ে তাঁর চিকিৎসা চলছে। ওই মেডিক্যাল বোর্ডে থাকা থাকা চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী রবিবার বলেছেন, ‘‘সিডেশন (আচ্ছন্ন করে রাখার প্রক্রিয়া) কমিয়ে দেওয়ার ফলে উনি কানে শুনতে পাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন, আশপাশটা অনুভব করতে পারছেন। আমরা ডাকলে উনি তাকাচ্ছেন, মাথা নাড়ছেন। কখনও কখনও ইশারায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বোঝানোরও চেষ্টা করছেন।’’ বুদ্ধদেবের ব্লাডগ্যাসের মাত্রা ধারাবাহিক ভাবে মাপা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন কৌশিক। তিনি আরও জানান, ব্লাডগ্যাসের মাত্রা ৫০-এর মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বুদ্ধদেব এখনও বিপন্মুক্ত নন। বরং, সঙ্কটজনকই রয়েছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা।
গত ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত চার বার হাসপাতালে ভর্তি করানো হল বুদ্ধদেবকে। তার মধ্যে ২০২১ সালে ভর্তি হয়েছিলেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। এ বার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর চিকিৎসার জন্য মেডিসিনের চিকিৎসক কৌশিকের পাশাপাশি, ক্রিটিক্যাল কেয়ারের চিকিৎসক সৌতিক পাণ্ডা ও সুস্মিতা দেবনাথ, কার্ডিয়োলজির সরোজ মণ্ডল, পালমোনোলজিস্ট অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্টারনাল মেডিসিনের ধ্রুব ভট্টাচার্য, অ্যানাস্থেশিয়ার আশিস পাত্র এবং হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার সপ্তর্ষি বসু ও চিকিৎসক সোমনাথ মাইতিকে নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। রবিবার পরিস্থিতি বুঝে মেডিক্যাল বোর্ডে সংক্রামক রোগ-বিশেষজ্ঞ দীপনারায়ণ মুখোপাধ্যায় এবং এন্ডোক্রিনোলজির সেমন্তী চক্রবর্তীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শনিবার বুদ্ধদেবকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর সেখানে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। কথা বলেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য এবং একমাত্র সন্তান সুচেতন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। পরে দফায় দফায় হাসপাতালে গিয়েছিলেন সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র, বর্ষীয়ান নেতা রবীন দেব, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য। রবিবার বেলার দিকে হাসপাতালে যান বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। বিকেলে যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মেডিক্যাল বোর্ডের বৈঠকে হাজির ছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত।
সকালের বুলেটিন
রবিবার সকালের বুলেটিনেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, নতুন করে আর অবস্থার অবনতি হয়নি বুদ্ধদেবের। দুপুরে তাঁর বুকের সিটি স্ক্যান করানো হবে বলেও প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছিল আলিপুরের বেসরকারি হাসপাতালটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, সকালেই বুদ্ধদেবের চিকিৎসার জন্য তৈরি করা মেডিক্যাল বোর্ড বৈঠকে বসে ঠিক করে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। সংক্রমণের জেরে ফুসফুসের কতটা ক্ষতি হয়েছে, সিওপিডি কী অবস্থায় আছে এবং নিউমোনিয়া কতটা গুরুতর অবস্থায়— এ সব জানতেই সিটি স্ক্যানের কথা ভাবা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, বুদ্ধদেবের ফুসফুস এবং শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তা নিয়ন্ত্রণে আনতে স্যালাইনের মাধ্যমে দিতে হচ্ছে কড়া ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক। এর ফলে প্রভাবিত হচ্ছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কিডনি। অনেকটা বেড়ে গিয়েছে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা। ফলে সংক্রমণ কমাতে গিয়ে কিডনির সমস্যা যাতে তৈরি না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।
কী বলছেন চিকিৎসকেরা
রবিবার বুদ্ধদেবকে দেখে গিয়েছেন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ সরোজ মণ্ডল। ইকো কার্ডিয়োগ্রাম করিয়েছেন চিকিৎসক ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার রিপোর্ট ভাল বলে জানিয়ে চিকিৎসক কৌশিক বলেন, ‘‘বুদ্ধদেববাবুর ‘কার্ডিয়াক ফাংশন’ (হৃদ্যন্ত্রের কাজ) বেশ ভাল। তাই ফুসফুসের অবস্থা খারাপ থাকলেও উনি লড়ে যাচ্ছেন। শরীরে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইনসুলিন দেওয়া হচ্ছে। রাইলস টিউবের মাধ্যমে তাঁকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। কোনও সমস্যা ছাড়াই তাঁর খাদ্যনালী দিয়ে খাবার শরীরে ঢুকছে। এটা ভাল লক্ষণ।’’ চিকিৎসক জানিয়েছেন, শনিবার সন্ধ্যা থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা বদলানো হয়েছে। তাই সোমবারের আগে আর নতুন কোনও পরীক্ষা করা হচ্ছে না। সেই সময় কৌশিক জানান, আপাতত সিটি স্ক্যানও করানো হচ্ছে না। তাঁর কথায়, ‘‘২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা সময় দিতে চাই যাতে তিনি স্থিতিশীল হতে পারেন। তার পর প্রয়োজন বুঝে সিটি স্ক্যান করব। বুদ্ধদেববাবুর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কেমন হয়, কৃত্রিম ভাবে যে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে তার প্রয়োজন কমে কি না, তা দেখে সোম, মঙ্গলবারের মধ্যে আগামী কর্মপন্থা ঠিক করা হবে। পরিস্থিতি যেমন আশা করছি, তেমন থাকলে তাঁকে আগামিদিনে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট ক্রমশ কমিয়ে সেখান থেকে বার করার চেষ্টা করা হবে।’’
হাসপাতালে শুভেন্দু
রবিবার বেলা ৩টে ৪৮ মিনিটে আলিপুরের বেসরকারি হাসপাতালে পৌঁছন বিরোধী দলনেতা। প্রায় ৪০ মিনিট ভিতরে ছিলেন তিনি। কথা বলেন চিকিৎসক ও উপস্থিত সিপিএম নেতাদের সঙ্গে। বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‘এইরকম একজন সৎ রাজনীতিক বাংলার দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধার। আমি ঈশ্বরের কাছে তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।’’ মেডিক্যাল বোর্ডের বৈঠকে হাজির ছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, ‘‘কাল রাত (শনিবার) থেকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। সেন্স এসেছে। ডাকলে সাড়া দিচ্ছেন। সংক্রমণের যা উপসর্গ ছিল, তা কমেছে।’’ গত কালের তুলনায় কি তাহলে অবস্থার উন্নতি বলা যায়? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সূর্যকান্ত বলেন, ‘‘স্পষ্ট পার্থক্য নজরে পড়েছে।’’ হাসপাতালে এসে বুদ্ধদেবের খোঁজ নিয়েছেন ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি, সিপিএম নেতা রবীন দেব, সুজন চক্রবর্তী, কংগ্রেসের কৃষ্ণা দেবনাথ, শুভঙ্কর সরকার প্রমুখ।