ইচ্ছে-উড়ান: মনের কথা আকাশপথে। বৃহস্পতিবার, উত্তর কলকাতার রামবাগানে। ছবি: সুমন বল্লভ
কেউ ঘুড়ির উপরে লিখেছে, সে শিক্ষিকা হতে চায়। কারও ঘুড়িতে আবার লেখা, সে চায় পুলিশ হতে। কেউ আবার নিজের ঘুড়িতে লিখেছে তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের কথা। লকডাউনে স্কুল বন্ধ। তার উপরে করোনা আবহে উত্তর কলকাতার গিরিশ পার্ক থানা এলাকার রামবাগান বস্তির এই খুদেদের অনেকেরই মা-বাবার উপার্জন তলানিতে এসে ঠেকেছে। কিন্তু বড় হওয়ার স্বপ্নে দাঁড়ি পড়েনি। নিজেদের নাম, বাড়ির ঠিকানা আর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে ঘুড়ির গায়ে লিখে ওরা আকাশে উড়িয়ে দিল বিশ্বকর্মা পুজোর সকালে।
রামবাগান বস্তির সরু গলির মধ্যে একটি ভাঙাচোরা বাড়ির দোতলার ছাদে এ দিন জড়ো হয়েছিল জনা পনেরো খুদে। মাথার উপরে শরতের নীল আকাশ। ওই এক টুকরো আকাশেই ওরা খুঁজে পেল মুক্তির স্বাদ। হাতে পাওয়া ঘুড়ি আকাশে ভাসিয়ে দেওয়ার আগে ওরা তাতে লিখে দিল নিজেদের স্বপ্নের কথা। সঙ্গে নাম-ঠিকানাও।
ওদেরই এক জন স্বর্ণদীপ রাজুয়া। স্বর্ণদীপ ঘুড়িতে লিখেছে, সে বড় হয়ে পুলিশ হতে চায়। তার পাশে বসা কেয়া দাস চায় শিক্ষিকা হতে। ওদের বন্ধু আদিত্য দাস ঘুড়ির কাগজে লিখেছে, সে বড় হয়ে গায়ক হতে চায়। আর সানন্দিতা নামের আর এক খুদের স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়া।
ওই খুদেদের প্রত্যেককে একটি করে ঘুড়ি ও স্কেচ পেন কিনে দিয়েছিলেন এলাকার মাস্টারমশাই শঙ্কর সরকার। প্রাক্তন সরকারি কর্মী শঙ্করবাবু অবসর নেওয়ার পরে এখন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে রামবাগান বস্তি এলাকার বাচ্চাদের পড়ান। তিনি বলেন, ‘‘ওদের প্রত্যেকের পরিবার এমনিতেই খুব গরিব। করোনা পরিস্থিতি জীবনকে আরও দুঃসহ করে তুলেছে। কিন্তু তার মধ্যেও তো বাচ্চাদের একটু আনন্দ খুঁজে দিতে হবে। তাই ওদের একটা করে ঘুড়ি কিনে দিয়েছিলাম। সেই সঙ্গে বলেছিলাম, ওরা বড় হয়ে কী হতে চায়, সেই ইচ্ছের কথা ও নাম-ঠিকানাও যেন লিখে দেয় ঘুড়িতে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ওই ঘুড়ি উড়তে উড়তে কোথাও গিয়ে পড়লে সেই লেখা দেখে কেউ যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তা হলে খুব উপকার হয়। তাই ঘুড়িতে নাম-ঠিকানাও লিখতে বলেছিলাম।’’
তবে খুদেরা অবশ্য অতশত জানে না। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন একটু ঘুড়ি ওড়াতে পেরেই ওরা খুশি। সবাই যে খুব ভাল ঘুড়ি ওড়াতে পারে, তা-ও নয়। ঘুড়ি ওড়াতে সাহায্য করার জন্য পাড়ার বড় দাদা-দিদিদেরও ডেকে এনেছিল ওরা।
ঘুড়ির কাগজে ওই খুদেরা নিজেদের যে সব স্বপ্নের কথা লিখেছে, তা বাস্তবে পরিণত করা যে কত কঠিন, তা তারা খুব ভাল ভাবেই জানে। ওদের কারও বাবা ঘুরে ঘুরে শাড়ি বিক্রি করেন, কারও বাবা কারখানার শ্রমিক, কারও বাবার ছোট দোকান আছে ফুটপাতে। এই করোনা আবহে বাড়িতে রোজ দু’বেলা খাবারও জোটেনি অনেকের। তার মধ্যে স্কুল বন্ধ বলে মিড-ডে মিলটাও পাচ্ছে না ওরা। তাই শুধু পড়াশোনা নয়, ওদের জন্য পেট ভরাতেও স্কুল খোলাটা জরুরি। ঘুড়িতে নিজের নাম ও স্বপ্নের কথা লিখতে লিখতে বছর বারোর স্বর্ণদীপ বলল, ‘‘ঘুড়িতে যা লিখলাম, পড়াশোনা না করলে সেই স্বপ্ন পূরণ হবে না। স্কুল না খুললে পড়াশোনা করব কী ভাবে?’’