স্বজনহারা: মারাদোনার শোকে বিহ্বল কলকাতার বৌমা। নিজস্ব চিত্র
‘লোকটা ঈশ্বরের বরপুত্র, আবার শয়তান তাকে বশ করেছিল।’
বেহালা চৌরাস্তায় শ্বশুরবাড়িতে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন রোক্সানা আকোস্তা সোসা। ভালবাসা। রাগ। যন্ত্রণা। কিংবা আরও কিছু? অনুভূতিগুলো এখনও দলা পাকিয়ে কলকাতার আর্জেন্টিনীয় বৌমার। এ শহরের স্থায়ী বাসিন্দা, মধ্য তিরিশের তরুণী। মারাদোনার দেশের সঙ্গে কলকাতার সব থেকে কাছের সেতু সম্ভবত তিনিই। এ দেশের বুধবার রাতে দুঃসংবাদটা পাওয়া ইস্তক ঘোরের মধ্যে ফেসবুকে খালি মারাদোনাকে নিয়েই ‘পোস্ট’ লিখে চলেছেন।
অথচ দু’বছর আগে গত বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ে নীল-সাদা টিমের মেয়ে কিন্তু মারাদোনার কথা উঠতে খানিক বিরক্তই হয়েছিলেন। সে-বারও তো জলঘোলা কম হয়নি লোকটাকে নিয়ে। “দিয়েগো চিরশ্রেষ্ঠ ফুটবলার! কিন্তু যতটা সম্মান ওর প্রাপ্য, ততটুকুই ওকে দিই, তার বেশি নয়”, সে-বার বলেছিলেন রোক্সানা। তখনও নাইজিরিয়ার সঙ্গে আর্জেন্টিনার গ্রুপ ম্যাচে গ্যালারিতে বসে প্রতিপক্ষকে মধ্যমা প্রদর্শন করে ধিক্কৃত মারাদোনা। কলকাতার তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর স্ত্রী রোক্সানা বাড়িতে টিভি দেখতে দেখতেই দিয়েগোর ঠোঁট নড়া পড়ে বুঝে নিয়েছিলেন স্প্যানিশে কী-কী বাছাই গালমন্দ করছে লোকটা। এবং মুখ লাল করে গুম হয়ে বসেছিলেন।
সেই রোক্সানাই এখন বলছেন, “দিয়েগো চলে যাওয়ার পরে কোরিয়েন্তেসে আমার বাবার পাশে খুব থাকতে ইচ্ছে করছে। বাবারা ফকল্যান্ড যুদ্ধের অপমান গায়ে মেখেছেন। আবার মেক্সিকোয় দিয়েগোর বদলা, বিশ্বকাপ জয়েরও সাক্ষী। আমি তো তখন মোটে এক বছরের। বাবাদের প্রজন্মই বোঝে, একটা দিয়েগো মারাদোনা কী ছিল তাদের জীবনে!’’
কলকাতায় মাছের ঝোল রান্না করা বৌমা রোক্সানাও কি বোঝেন না? “এ দেশে এসে ২০১৫ সালে বিয়ে করা ইস্তক যেখানেই যাই কারও সঙ্গে আলাপ হতেই মারাদোনার নাম। আমার বর চিরঞ্জীব ঠাকুরের সঙ্গে
চ্যাটে আলাপ হতেও প্রথমেই দিয়েগোর কথা বলেছিল। দিল্লি, জয়সলমির, সিকিম সর্বত্র এক কাণ্ড!” ২০১৭ সালে তাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েও রোক্সানা বোঝেন, দিয়েগো মারাদোনা তাঁরও আত্মপরিচয়ের অংশ।
“আর্জেন্টিনায় আমাদের কোরিয়েন্তেস প্রদেশ ঘেঁষেই ব্রাজ়িল। আকছার ওখানেই ছুটিতে যেতাম! তখনও শুনতে হত, দিয়েগো এই করেছে, সেই করেছে।” বুয়েনোস আইরেসের গরিবপাড়ায় দিয়েগো জন্মালেও তাঁর বাবা ডন দিয়েগো কিন্তু তাঁদের কোরিয়েন্তেসের এসকিনা থেকেই রাজধানী পাড়ি দিয়েছিলেন, সে গর্বও ভোলেননি রোক্সানা। তবে আর্জেন্টিনায় কোভিড-বিধি ভুলে মারাদোনার শোকে আত্মহারা জনতার পথে নামার মধ্যে একটা ক্ষোভের আঁচও রয়েছে। রোক্সানা বলছিলেন, মারাদোনার অসুস্থতার খবরটা কয়েক দিন ধরেই ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর বাড়ির সামনে ৮-১০টা অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশ ছয়লাপের ছবিটা অনেকেই ভাল ভাবে নেননি। কারণ, অতিমারিতে অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় মৃত্যু তো আর্জেন্টিনায় কম ঘটেনি। অবশ্য রোক্সানা মনে করেন, এর জন্য দিয়েগোকে দোষ দেওয়ারও মানে নেই! তাই পুরনো সমালোচনা ভুলে ফেসবুকে লিখছেন, ‘দুনিয়া আর্জেন্টিনা বলতে মারাদোনাই বোঝে, দেশে অপদার্থ প্রশাসন থাকাটা মারাদোনার দোষ নয়!’ মাদকসেবী, বহুগামী মারাদোনার পরিবার, মেয়েদের জীবনে চাপটা কম ছিল না বুঝেও রোক্সানা এখন অনড়, “আমি কেউ নই, ওর ভালমন্দ বিচারের!” ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে খবরটা পেয়ে ফোন করেছিলেন বোকা জুনিয়ার্স ভক্ত ভাই মিকেলকে। “খুব কষ্ট হচ্ছে। শেষ দিনগুলো পরিবারের কেউ নয়, শুধু নার্সরা ছিল দিয়েগোর কাছে!” দেশে ফেরার উপায় নেই, এখন প্রবাদপ্রতিম দশ নম্বর নীলসাদা জার্সিই কলকাতাতেও সম্বল রোক্সানার।
মায়ের ‘ইয়োগা স্কুল’-এর সূত্রে ছোট থেকেই ভারত নিয়ে উৎসুক আর্জেন্টিনীয় তরুণী কলকাতার যুবক চিরঞ্জীবকে ফেসবুকে একটি ভারত-বিষয়ক পেজের সূত্রেই চিনেছিলেন। বাঙালি বাড়ির বৌমা হিসেবে পাঁচ বছরে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন। তবে দিয়েগোর দেশের মেয়ে বুঝছেন, চির বাউন্ডুলে লোকটা ঘুমোলেও ছাড়ান নেই তার থেকে! লোকটা বেঁচে থাকতেই বরং দূরত্ব ছিল। মৃত্যুতে সেই নাছোড় সম্পর্কের একটা নতুন অধ্যায়ের শুরু...