ফাইল চিত্র
সংক্রমণের গতি থামানোর একটা উপায় সম্পূর্ণ লকডাউন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সপ্তাহে দু’দিন লকডাউনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে স্বাগত। কিন্তু সংক্রমণ যে হারে ছড়াচ্ছে, তাতে সপ্তাহে দু’দিন নয়, টানা দু’সপ্তাহ সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করা জরুরি। তাতে মানুষের সঙ্গে মানুষের ‘কন্ট্যাক্ট’ বন্ধ করা যাবে। আর যাঁরা সংক্রমিত হয়েছেন অথচ উপসর্গ দেখা দেয়নি, ওই সময়ের মধ্যে তাঁদের শরীরেও কিছু উপসর্গ হয়তো ফুটে উঠবে।
এ ক্ষেত্রে মুম্বইয়ের ধারাভির উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথম যখন ধারাভিতে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল, তখন মনে হয়েছিল এই সংক্রমণ রোখা যাবে কী করে! কারণ, এত ঘন জনবসতি, সেখানে দাবানলের মতো সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সমস্ত নিয়ম নেমে সেই সংক্রমণের বিস্তার আটকানো গিয়েছে। বিশ্বের ঘন জনবসতিপূর্ণ শহরগুলির মধ্যে কলকাতা অন্যতম। এখানেও অনেক বস্তি রয়েছে। গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বাড়ি রয়েছে। শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরই হোম আইসোলেশনে আলাদা থাকার জন্য পৃথক ঘর নেই। ফলে কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে সংক্রমণ রোখাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
সংক্রমণ রুখতে হলে প্রথমেই যেটা করতে হবে তা হল, কারা ইতিমধ্যেই সংক্রমিত, তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে। তার জন্য নমুনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যত বেশি নমুনা পরীক্ষা হবে, তত বেশি সংক্রমিত মানুষকে চিহ্নিত করা যাবে এবং তাঁদের বাকি জনগোষ্ঠীর থেকে আলাদা করা যাবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাঁকে বাকিদের থেকে আলাদা করা— এটাই সংক্রমণের গতি থামানোর প্রথম ধাপ। আবার কোনও এলাকায় যদি ‘চেন অব ট্রান্সমিশন’ বা সংক্রমণের প্রবাহরেখার উৎস খুঁজে না-পাওয়া যায়, তা হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মানুষের অবাধ চলাচল সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করতে হবে। আমরা জেনেছি, কলকাতার অনেক সংক্রমিত এলাকায় লোকজন এখনও অবাধে ঘোরাফেরা করছেন। এটা করলে হবে না। কারণ, এক জন সংক্রমিত মানুষ নিজের অজান্তেই আরও অনেককে সংক্রমিত করতে পারেন। সেই সংক্রমিতেরাও ক্রমশ অন্যদের সংক্রমিত করতে পারেন। সংক্রমণের বৃত্ত এ ভাবেই আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ফলে এ দিক থেকে সতর্ক থাকা সবচেয়ে জরুরি।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই ভাইরাসের চরিত্র এখনও আমাদের কাছে পুরো স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দিষ্ট সময় অন্তর গবেষণায় উঠে আসা তথ্য এবং সংক্রমণ রুখতে হলে কী দরকার, সেটা আমাদের জানাচ্ছে। যতক্ষণ না পরিস্থিতি স্থিতিশীল হচ্ছে, ততক্ষণ আমাদের তিনটি জিনিস মনে রাখতে হবে। খুব ‘বেসিক’, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ‘জিনিস’— মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং দূরত্ব-বিধি মেনে চলা। কলকাতায় এখনও বেশির ভাগ জায়গায় এই নিয়মগুলি ঠিক মতো পালন করা হচ্ছে না। আমরা জানি, এখনও জনসংখ্যার একটি শ্রেণি মাস্ক না-পরেই রাস্তায় বেরোচ্ছেন, জটলা করছেন। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস ‘রেসপিরেটরি’ ভাইরাস। অর্থাৎ, এটা শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে। এমনিতেই এই ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতা অনেক বেশি। সেখানে সার্স-কোভ-২ এর ক্ষমতা তো আরও বেশি। ফলে এই তিনটি নিয়ম অগ্রাহ্য করে অবাধ যাতায়াত চলতে থাকলে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। তাই সম্পূর্ণ লকডাউন ও ঠিক ভাবে নিয়ম পালন করা, এই দুইয়ের মাধ্যমে সংক্রমণের গতি থামাতে পারে কলকাতা।
(লেখক ওয়ার্ল্ড সোসাইটি ফর ভাইরোলজি-র প্রেসিডেন্ট এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি-র এমেরিটাস বিজ্ঞানী)
আরও পড়ুন: বাজার-দোকানের সময় নির্দিষ্ট হল কামারহাটি ও বরাহনগরে