চেনা এজলাসে অচেনা দৃশ্যের জন্ম হল কলকাতা হাই কোর্টে। — ফাইল ছবি।
গুরুগম্ভীর এজলাসে উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রকবিতা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের গলায়! চেনা এজলাসে এমন অচেনা দৃশ্যেরই সাক্ষী থাকল কলকাতা হাই কোর্ট। ৭৬ বছর বয়সী শ্যামলী ঘোষ বৃহস্পতিবার এসেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে। তাঁকে বসে থাকতে দেখে কথা বলেন বিচারপতি। আলাপচারিতা অন্য দিকে মোড় নেয় বৃদ্ধা যখন রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে আবৃত্তি করে ওঠেন। বৃদ্ধার রবীন্দ্রপ্রেমে খানিক বিস্মিত বিচারপতি জবাব দেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়েই।
ঘটনার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটা নাগাদ। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৭ নম্বর এজলাসে বেঞ্চে বসে শিক্ষিকা শ্যামলী ঘোষ। তাঁকে উদ্দেশ্য করে বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনি আদালতে এসেছেন কেন? আবার কী প্রয়োজন পড়ল? আপনার মতো প্রবীণ মানুষকে আদালতে আসতে দেখলে খারাপ লাগে। কেন কষ্ট করে আদালতে আসেন? যা পাওনা ছিল, তা তো পেয়ে গিয়েছেন।’’ বিচারপতির কথা শুনে হাতজোড় করে সামনে এগিয়ে এসে শ্যামলী বলেন, ‘‘ধর্মাবতার, আজ আমার মামলা রয়েছে। আপনার নির্দেশে জীবনের শেষ ধাপে এসে নিজের প্রাপ্য পেয়েছি। তবে যারা কেড়ে নিয়েছিল, তাদের উপযুক্ত শাস্তি আশা করেছিলাম।’’ বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনার মামলার বিচার হবে। কিন্তু তার জন্য সময় লাগবে। আপনি এ ভাবে প্রায়ই আদালতে চলে আসবেন না। যখন প্রয়োজন হবে আপনাকে ডেকে পাঠাব।’’ শ্যামলীর জবাব, ‘‘আপনাকে দেখতে আসি। আপনি কেমন আছেন?’’ মুচকি হেসে বিচারপতির জবাব, ‘‘বেঞ্চে বসে বিচার করছি মানে ভালই আছি।’’ তার পরেই শ্যামলী আবার প্রশ্ন করেন, ‘‘আমি এলে কি কোনও অসুবিধা হয়?’’ বিচারপতি বলেন, ‘‘অসুবিধা থাকবে কেন! আপনার এত বয়স! এই বয়সে কোর্টে আসছেন, দেখতে ভাল লাগে না। ঠিক আছে, আপনার যা ইচ্ছা হয় তাই করুন। কী আর বলব!’’
এর পর ফের বেঞ্চে গিয়ে বসেন শ্যামলী। কিছু ক্ষণ পর তাঁর মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। বৃহস্পতিবার এডিআই-এর বিরুদ্ধে আদালতে রিপোর্ট জমা দেয় রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশন। সেই রিপোর্ট দেখে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, শিক্ষা দফতরের সচিবকে এই রিপোর্ট পাঠাবে ভিজিল্যান্স কমিশন। তার ভিত্তিতে এডিআই উলুবেড়িয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা দফতর।
এ কথা বলেই শ্যামলীকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ বার তো আপনার মামলা হয়ে গিয়েছে। বাড়ি চলে যান।’’ শ্যামলী আলতো হেসে বলেন, ‘‘কেন অবেলায় ডেকেছ খেলায়, সারা হয়ে এল দিন। বৃদ্ধ বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূরবীতে এই কবিতা লিখেছিলেন কাদম্বিনীর উদ্দেশে। আমিও শেষ বয়সে এসে বিচার পেয়ে উপলব্ধি করলাম। বিধবা অবস্থায় ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছি।’’
বিচারপতি বৃদ্ধাকে বলেন, ‘‘কবিতা ভালবাসেন দেখছি। যাঁরা কবিতা ভালবাসেন, তাঁরা খারাপ হন না। আপনি তো রবীন্দ্র অনুরাগী! শেষবেলায় বিচার পাচ্ছেন, তাই মনে রাখবেন— এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’’
২৫ বছর ধরে বেতন না পাওয়ায় মামলা করেছিলেন শ্যামলী। সেই মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে বকেয়া বেতন-সহ প্রায় ৪০ লাখ টাকা পেয়েছেন শ্যামলী। কিন্তু তার পরেও সমস্যা তাঁর পিছু ছাড়েনি। বৃহস্পতিবার সেই প্রক্রিয়াই সমাপ্তির পথে পা বাড়াল মামলাকারী এবং বিচারপতির কণ্ঠে রবীন্দ্রকবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। হাই কোর্টে বিরল ঘটনাই বটে!