দিল্লির কড়া নজরে বাংলা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাংলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে নালিশের কমতি নেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগও কম নয়। বিধানসভা নির্বাচনে স্বপ্নপূরণ না হওয়ার পরেই উঠেছিল ভোট পরবর্তী ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগ। সেই অভিযোগের অভিঘাত থামার আগেই রাজ্য বিজেপির তরফে রাশি রাশি অভিযোগ জমা পড়েছে কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রকের টেবিলে। আদালতেও গিয়েছে গেরুয়া শিবির। অনেকগুলি ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশে তদন্ত গিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে। তবে শুধু কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাতেই রেহাই নেই। ‘দোসর’ হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেও একের পর এক অনুসন্ধান দল এসে চলেছে রাজ্যে। তাতে যে তৃণমূল খুশি নয়, তা মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেই স্পষ্ট। সোমবারই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাগরদিঘিতে বলেছিলেন, ‘‘এখন তো চকলেট বোমা ফাটলেও এনআইএ তদন্ত করতে চলে আসছে।’’ আর বৃহস্পতিবার আলিপুরদুয়ারের সভা থেকে মমতার কটাক্ষ, ‘‘উইপোকা কামড়ালেও কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে!’’
তবে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এমন প্রতিক্রিয়াকে দোষ দেওয়া যাবে না। ২০২১ সালের মে মাস থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রায় ২০ মাসের হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে কমপক্ষে ৩৬টি প্রতিনিধিদল এসেছে দিল্লি থেকে। অর্থাৎ, মাসে দেড়টিরও বেশি! এর মধ্যে কোনওটি রাজনৈতিক, কোনওটি প্রশাসনিক।
অনেকের মতে, দিল্লি লাগাতার প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে মমতার সরকারকে ‘চাপে’ রাখতে। যার মূল লক্ষ্য রাজ্যের রাজনীতিতে কয়েক কদম এগিয়ে থাকা। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদলে তা থেকে যাতে মমতা ‘রাজনৈতিক ফায়দা’ তুলতে না-পারেন, সে কারণেই সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে দল পাঠানো হচ্ছে। আবার অনেকের মতে, কেন্দ্রকে দিল্লির দল পাঠাতে হচ্ছে রাজ্যের বিজেপি নেতাদের গুরুত্ব এবং সম্মান রক্ষার্থে। নইলে তাঁরা ভাবতে পারেন, তাঁদের অভিযোগকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাতে তাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। এই অংশের মতে, সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে সরকার দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। রাজ্যের প্রশাসনযন্ত্রকে মোকাবিলা করতে তাই কেন্দ্রের প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলার উপরে দিল্লির এই কড়াচোখে নজরদারির পালা শুরুটা হয়েছিল রাজনৈতিক ভাবেই। ভোট পরবর্তী ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে প্রথম তথ্যানুসন্ধান কমিটি গড়েন বিজেপি সভাপতি জেপি নড্ডা। সেই দল আসার আগে তিনি নিজেও চলে আসেন বাংলায়। বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে পরেই। লকডাউনের মধ্যেই হয়েছিল নড্ডার সফর। দলের বহু কর্মী আক্রান্ত এবং ঘরছাড়া বলে নালিশ গিয়েছিল রাজ্য বিজেপির তরফে। ভোটের ফল ঘোষণার পর দিনই নবান্নকে চিঠি পাঠায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। আর ৬ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের চার সদস্যের প্রতিনিধি দল আসে রাজ্যে। সেই কেন্দ্রীয় দলে ছিলেন বাংলার বর্তমান রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসও।
বাংলায় দলের পর দল। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
ভোট পরবর্তী ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগ নিয়ে এখনও সরব বিজেপি। চলতি জানুয়ারি মাসেই ‘বাংলায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত’ অভিযোগ তুলে একটি বেসরকারি সংগঠনকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। এই মুহূর্তে বাংলার জেলায় জেলায় নানা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ঘুরছে প্রতিনিধিদল। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতে ১২ টি জেলায় ‘ন্যাশনাল লেভেল মনিটরিং’ দলের পরিদর্শন চলছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনা নিয়েও এই দল পরিদর্শন করবে।
জানুয়ারির গোড়াতেই পূর্ব মেদিনীপুর ও মালদহ জেলায় আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দু’টি কেন্দ্রীয় দল এসেছিল। এর পর আরও পাঁচটি দলের পরিদর্শন চলার কথা ১০টি জেলায়। রেশন দোকান ঘুরে দেখতেও এই জানুয়ারিতেই রাজ্যে এসেছে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল। রাজ্যে ‘মিড ডে মিল’ প্রকল্পের পরিস্থিতি পরিদর্শনের জন্যও সাত সদস্যের কেন্দ্রীয় দল এই মুহূর্তে রয়েছে।
২০২১ সালের ৫ মে তৃতীয় বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকে গত দেড় বছরে বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের নানা প্রতিনিধিদল পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসেছে। যা নিয়ে মমতা তো বটেই, তৃণমূল নেতারাও প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। ভোট পরবর্তী ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে নড্ডার দল ছাড়াও ২৪ জুন রাজ্যে এসেছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিরা। রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল কমিশন। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলায় আইনের শাসনের বদলে শাসকের আইন চলছে। তার আগেই একই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ২০২১ সালের ১৩ মে জাতীয় তফলি কমিশন, ১০ জুন জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন এবং ১৫ জুন জাতীয় তফসিলি উপজাতি কমিশন প্রতিনিধি দল পাঠায় রাজ্যে। সেই সব রিপোর্ট রিপোর্ট ‘হাতিয়ার’ করেই কোনও মামলায় সিবিআই, কোনও ক্ষেত্রে এনআইএ রাজ্যের শাসকদলের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। সেই সব তদন্ত এখনও চলছে। প্রায়শই জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয় শাসকদলের নেতা, সাংসদ, বিধায়কদের। গত দেড় বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা মন্ত্রকের প্রতিনিধিদলও রাজ্যে এসেই চলেছে। যাকে ‘পর্যটন’ বলে কটাক্ষ করেছেন অনেক তৃণমূল নেতা।
তৃণমূল মনে করে, রাজ্যে এই বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রীয় দল আসার পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার নামবদল থেকে গ্রামীণ আবাস যোজনায় প্রাপকদের তালিকায় যোগ্যরা না থাকা নিয়ে তিনিই কেন্দ্রকে নালিশ জানিয়েছেন। গোপনে নয়, বার বার সেই নালিশের কথা কখনও প্রকাশ্য বক্তব্যে, কখনও টুইট করে জানিয়েছেন শুভেন্দু।
শুভেন্দু কেন্দ্রকে চিঠি দিয়ে দাবি করেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’র নাম বদলে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ করা হয়েছে। আরও একটি অভিযোগ ছিল কেন্দ্রের ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পের নামবদল নিয়ে। রাজ্যে ‘জল স্বপ্ন’ নামে প্রকল্পটি চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন শুভেন্দু। রাজ্যকে ওই দুই প্রকল্পের নামবদলের কথা বলে কেন্দ্র। তা নিয়ে দিল্লির সঙ্গে নবান্নের অনেক বাদানুবাদ হয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর নাম ফিরিয়েও আনতে হয়েছে রাজ্যকে।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয় ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প এবং আবাস যোজনা নিয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল পাঠানো। ১৭ জানুয়ারি প্রথমবার আসে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের দল। রাজ্যের ১৬ জেলায় ‘ন্যাশনাল লেভেল মনিটর’ দলের প্রতিনিধিরা ঘোরেন। আবার জুলাই মাসে ‘বাংলা গ্রামীণ সড়ক যোজনা’ বনাম ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা’ লড়াইয়ের সারবত্তা দেখতে ২৫ জুলাই রাজ্যের ১৫ জেলায় ১৫টি দল আসে।
এ তো গেল সরকারি প্রকল্পের পরিস্থিতি এবং অভিযোগ খতিয়ে দেখার ধারাবাহিক নজরদারি। এ ছাড়া রাজ্যের কয়েকটি ঘটনা নিয়েও বিজেপি কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়েছে বাংলায়। বগটুইকাণ্ডের পরে নড্ডা একটি সংসদীয় দল পাঠিয়েছিলেন। ২৪ মার্চ সেই দল বগটুইতে যায়। গত সেপ্টেম্বরে বিজেপির ‘নবান্ন অভিযান’ কর্মসূচিতে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ তুলে বলা হয়েছিল, বহু কর্মী জখম হয়েছেন। তা খতিয়ে দেখতে দিল্লি থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিনিধিদল আসে রাজ্যে। তার আগে এপ্রিল মাসে নদিয়ার হাঁসখালি ধর্ষণকাণ্ড এবং সেপ্টেম্বরে উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড়ের একটি স্কুলে বিস্ফোরণ নিয়ে দিল্লির দল এসেছে। প্রথমটির জন্য ১৩ এপ্রিল এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ২১ সেপ্টেম্বর রাজ্যে আসে জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশনের প্রতিনিধিদল।
এত তদন্তের কোনটির কী রিপোর্ট ছিল, তার বেশিটাই প্রকাশ্যে আসেনি। কোন রিপোর্টের ভিত্তিতে কোন সংস্থা কী পদক্ষেপ করেছে, তা-ও অজানা। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদল ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প বা আবাস যোজনা নিয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই রাজ্যের প্রাপ্য টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র। রাজ্যকে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (গ্রামীণ)-র আওতায় ১১ লক্ষ বাড়ি তৈরি করতে হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রের বরাদ্দ না-আসায় বঙ্গে আবাস-উপভোক্তাদের প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া যায়নি। এই প্রকল্পে প্রথম কিস্তিতে উপভোক্তা প্রতি ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। কমবেশি ১১ লক্ষ উপভোক্তার ক্ষেত্রে প্রথম কিস্তির জন্য দরকার প্রায় ৬,৬০০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে মোট খরচের ৬০% দেয় কেন্দ্র। সেই হিসাবে প্রথম কিস্তির বরাদ্দ হিসেবে কেন্দ্রের দেওয়ার কথা প্রায় ৩,৯৬০ কোটি টাকা। বাকিটা রাজ্যের। এখন যে পাঁচটি প্রতিনিধিদল রাজ্যে ঘুরছে, তাদের রিপোর্টের উপরেই নির্ভর করছে কত টাকা, কবে পাওয়া যাবে।
আবার ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের টাকা নিয়েও একই পরিস্থিতি। দীর্ঘ দিন ধরে নানা ‘অসঙ্গতি’র অভিযোগে রাজ্যের প্রাপ্য আটকে রেখেছে কেন্দ্র। সবই হয়েছে বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের রিপোর্টের ভিত্তিতে। সড়ক যোজনাতেও একই অবস্থা। গত ১৭ নভেম্বর কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে নবান্নকে জানানো হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনায় এ বছরে রাজ্যে মোট প্রায় ৫৮৫ কোটি টাকায় ১৪৪টি প্রকল্পের কাজ হবে। এর মধ্যে কেন্দ্র দেবে প্রায় ৩৪৩ কোটি এবং রাজ্যের ভাগে থাকবে বাকি ২৪২ কোটি টাকা। কিন্তু গত অর্থবর্ষের কিছু রাস্তার কাজ অসম্পূর্ণ থাকা নিয়েও রিপোর্ট পেয়েছে কেন্দ্র। তার পরেই রাজ্যের থেকে নানা তথ্য চেয়েছে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক।
নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘বিভিন্ন প্রকল্পে তথ্য চাওয়ার শেষ নেই কেন্দ্রের। যখন যেমন চাওয়া হচ্ছে, তখন তেমনই তথ্য পাঠানো হচ্ছে। তার পরে আবার নতুন করে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়ে রিপোর্ট চাওয়া হচ্ছে।’’ রাজ্য সরকার যে প্রতি ক্ষেত্রেই রিপোর্ট সময় মেনে পাঠিয়ে চলেছে, তা-ও জানান ওই কর্তা। কিন্তু তাতে দিল্লি থেকে দলের আগমন কমছে না!