গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অবৈধ সম্পর্ক ছাড়া সাহিত্য হয় না! বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের নায়ক। দেখা যাচ্ছে অবৈধ সম্পর্ক ছাড়া জীবনও সম্পূর্ণ হয় না।
সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে উত্তমকুমার ‘চোখের বালি’র কথা বলেছিলেন। একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নায়িকা বিনোদিনী একই সময়ে দু’জনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। তখনকার সেই সময়ে এই গল্পকে অতি দুঃসাহসিক বলে মনে করা হয়েছিল।
এখন সাহসের গণ্ডি আরও প্রসারিত। যে গণ্ডির প্রতিটি বাঁকে লেখা রয়েছে নুসরত জাহান, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বা শোভন চট্টোপাধ্যায়দের নাম।
নুসরত অন্য পাঁচজন নায়িকার মতোই পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তা প্রত্যাশিত। সিনেমা-থিয়েটারে নতুনও নয়। কিন্তু নুসরত নতুন যুগের নতুন নায়িকা। সাহসের সঙ্গে একাধিক শৃঙ্গ জয় করেছেন। যেমন, মুসলিম নাম নিয়েও টলি-জগতে উঠে এসেছেন প্রথম সারিতে। বলিউডে এমন বহু নাম শোনা যায়। বঙ্গদেশেও মুসলমান পরিবারের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু মুসলিম নায়িকা? বিশেষ শোনা যায়নি। নুসরতের অতীত যাকে বলে, যথেষ্ট ‘বর্ণময়’। তবে নিজেকে তিনি কোনও একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হতে দেননি। নায়িকা হিসেবে শীর্ষে থাকতে থাকতেই রাজনীতিতে এসেছেন। জনতার ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছেন।
নুসরতের সাংসদ সত্তা এবং নায়িকাসুলভ গ্ল্যামারঋদ্ধ উপস্থিতি— দু’টিতেই আলোকিত নেটমাধ্যম। কোথাও তিনি রূপসী অভিনেত্রী, কোথাও হটপ্যান্টে টিকটক তারকা। আবার কোথাও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শের মুখ। এ সবের মধ্যেই নুসরত প্রকাশ্যে আনলেন তাঁর নতুন পদক্ষেপ। তাঁর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন যখন তুঙ্গে, নায়িকা জানালেন তিনি মা হতে চলেছেন। আরো আছে। তাঁর সন্তানের জন্মদাতা যে ‘স্বামী’ নিখিল জৈন নন, তা-ও বোঝাতে দেরি করেননি। বরং গনগনে বিতর্কের মুখে দাঁড়িয়ে সটান বলেছেন, নিখিলের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য আদৌ বিয়ে নয়। তিনি নিখিলের সঙ্গে ‘লিভ-ইন’ করেছেন মাত্র।
শ্রাবন্তী টলি-পাড়ার নামী মুখ। সম্প্রতি নাম লিখিয়েছেন রাজনীতিতেও। বিজেপি-র হয়ে বিধানসভা ভোটে লড়েছেন। হেরেছেন। ব্যক্তিজীবনে বার তিনেক বিয়ে। এক সন্তানের মা। শ্রাবন্তীর কাহিনিতেও পরতে পরতে মোচড়। তাঁর তৃতীয় স্বামী যখন সংসার করতে চাইছেন মন দিয়ে, তার মধ্যেই আবার প্রেম! সে সম্পর্কও লুকিয়ে রাখার পক্ষে নন শ্রাবন্তী। বিবাহবিচ্ছেদের পর্বের মধ্যেই প্রকাশ্যে এনেছেন নতুন প্রেমিককে। সংবাদমাধ্যমে ঘুরছে যুগলের নিত্যনতুন ছবি। কখনও নতুন প্রেমিকের সঙ্গে একান্ত আড্ডায়। কখনও পরিবার-পরিজনকে নিয়ে প্রেমিকের জন্মদিন পালনে।
হলিউড এমন অনেক দেখেছে। প্রখ্যাত অভিনেত্রীদের বার কয়েক বিয়ে-সংসার ভাঙা-রঙিন প্রেমজীবন— সবই। তবে বঙ্গদেশ কেন, মুম্বইয়ের নায়িকাদেরও আগে এভাবে প্রেমের সোচ্চার নির্ঘোষে দেখা যায়নি। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু তা লুকিয়ে রেখেছেন হিন্দি ছবির নায়িকারা। খাতায়-কলমে একাধিক বিয়ে কমই দেখা গিয়েছে। কিন্তু শ্রাবন্তী আলাদা। যিনি প্রেমে পড়া বা বিবাহের ক্ষেত্রে আড়াল-আবডালে বিশ্বাস রাখেন না। নিজের পছন্দ নিয়ে স্পষ্ট।
তবে কি না শুধু বাংলার ছায়াছবির জগৎই বা কেন, বঙ্গ রাজনীতিও তো পিছিয়ে নেই প্রেমের সোচ্চার উচ্চারণে। টাটকা উদাহরণ শোভন। খাতায়-কলমে এখনও বিবাহিত তিনি। তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিবাহিতা। দক্ষিণ কলকাতার বহুতলের ফ্ল্যাটে দিব্যি সংসার পেতেছেন দু’জনে। রং মিলিয়ে শাড়ি-পাঞ্জাবির ফ্যাশন, একসঙ্গে দলত্যাগ, হাতে-হাত রেখে নতুন দলে যোগ— কোনও কিছুতেই তাঁদের রাখঢাক নেই। শোভনের কাছে রাজনীতি-বিষয়ক ফোনও বহুক্ষেত্রেই এখন যায় বৈশাখীর হাত ঘুরে। তাঁর কয়েক কোটির সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্বও প্রকাশ্যেই শোভন সঁপে দিয়েছেন বান্ধবী বৈশাখীর হাতে।
তবে রাজনীতিতে এমন সম্পর্কের সমীকরণ নতুন নয়। শোনা যায়, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অকৃতদার বিধানচন্দ্র রায়ের এক বান্ধবীর কথা। ‘মিসেস সেন’ নামে সেই মহিলার গল্প বহু ঘুরেছে কানে-কানে। প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর ছাত্রজীবনের এক বান্ধবীর কথাও বহুচর্চিত। সুবিদিত নানা দলের নানা নেতা-মন্ত্রীর তথাকথিত অবৈধ প্রেমকথাও। এই প্রবাহের বাইরে থাকেনি বাংলা সংবাদমাধ্যমও। সাংবাদিক-সম্পাদকের অকালপ্রয়াণের পর শোকপ্রকাশের বৈধতার মধ্যে অবৈধতার গন্ধ উঠে এসেছে। তা নিয়ে নেটমাধ্যমে শুরু হয়েছে প্রকাশ্য চাপানউতর।
এই ঘটনাপ্রবাহ কী বলছে? বঙ্গদেশের সমাজ কি বদলে যাচ্ছে? নতুন সমীকরণ দেখা দিচ্ছে নারী-পুরুষের সম্পর্কে? প্রেমের ধারনায় কি বিপ্লব ঘটছে? বিবাহের প্রাসঙ্গিকতা কি এখন কমে যাচ্ছে? গুপ্তপ্রেমের এই সোচ্চার আত্মপ্রকাশ তো আগে ছিল না। সমান্তরাল প্রেম ছিল। গল্প-কবিতায় তা বিধৃত আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ বা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চরিত্রহীন’ তো সেই গল্পই বলেছিল সেকালে। ইদানীংকার এই সোচ্চার আত্মপ্রকাশকে কি তা হলে ‘যৌন বিপ্লব’ বলা যায়? যাকে ইংরেজিতে বলে ‘সেক্সুয়াল রেভোলিউশন’?
অনেকের মতে, না। বরং একে বলা যেতে পারে প্রথাভাঙা প্রেমের বৈপ্লবিক আত্মপ্রকাশ। বঙ্গসমাজের এই অংশ বলছে, যৌন বিপ্লব হল ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’। অথবা ‘ফ্রেন্ডস ইউথ বেনিফিট’। অর্থাৎ, সুবিধার বিনিময়ে বন্ধুত্বের আবডালে শয্যা ভাগ করা। এই দু’টি তথাকথিত ‘বিপ্লব’ বলে— শয্যাসঙ্গী বা সঙ্গিনী হওয়ার জন্য প্রেমের প্রয়োজন হয় না। প্রেমহীন যৌনতা তো বিপ্লবই বটে! ফলে তাকে বলা যেতে পারে ‘যৌন বিপ্লব’ বা ‘সেক্সুয়াল রেভোলিউশন’। গুপ্তপ্রেমের সোচ্চার ঘোষণাকে নয়। কারণ, এর মধ্যে প্রথাসিদ্ধতা না থাকলেও প্রেম আছে। প্রেম আছে বলেই তার ঘোষণা আছে।
সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্রের বক্তব্য, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের চোখরাঙানির তোয়াক্কা করার দায় কমছে নারী-পুরুষ উভয়েরই। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিষ্ঠানটি কিছু দিনের মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক আখ্যা পেলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই!’’ লেখক তিলোত্তমা মজুমদারের আবার বক্তব্য, ‘‘একে এক সামগ্রিক সামাজিক বিপ্লব বলা চলে।’’
কেন বিপ্লব? উত্তমকুমার আর সুপ্রিয়াদেবী দু’জনেই বিবাহিত ছিলেন। কিন্তু সেই বিবাহের বাইরে দু’জনে সংসার করেছেন।
তিলোত্তমার মতে, সে ছিল সময়ের নিরিখে বিক্ষিপ্ত এক উদাহরণ। সে সময় টুইটার ছিল না। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামও ছিল না। তিলোত্তমা বলেন, ‘‘তখন ‘মি টু’ আন্দোলনও দেখেনি পৃথিবী। এখন জগৎ জানতে বাধ্য হয়েছে, প্রেম আর যৌনতার ভিত্তিতে শোষণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারলে তা লুকিয়ে রাখার দায় মেয়েদেরও নেই। এই আন্দোলন নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের বোধে সামগ্রিক বদল এনেছে।’’
সেই পরিবর্তিত বোধ বলছে, এমন তো সাহিত্য-সিনেমা-রাজনীতিতে কতই হয়ে থাকে বলে হিসেবের খাতা আর বন্ধ রাখা চলে না। আশেপাশে চেনা-পরিচিতের বৃত্তে আরও অনেকে নিজেদের প্রেমের কথা উচ্চারণ করেন স্পষ্টভঙ্গিতে। নেটমাধ্যম ধরে রাখে তার দলিল। বিতর্কের ঝড় ওঠে। তুফান ওঠে চায়ের পেয়ালায়। আলোচনার তরঙ্গ ছড়িয়ে যায় ফেসবুকের দেওয়াল থেকে দেওয়ালে। রসের ঘড়া ভরে ওঠে। করোনায় ক্রমাগত বিবর্ণ আর ধূসর হতে-থাকা বঙ্গজীবনে উঁকি মেরে যায় একচিলতে পরকীয়ার রং।