বড় বড় জনসভার দিন কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে ক’টা সভা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
শনিবার পর্যন্ত একটিও নয়।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়?
একটিও নয়।
তা হলে কি শাসক তৃণমূল আর ভোটের প্রচারে ভরসা রাখছে না? না কি তারা পঞ্চায়েত ভোট বলেই প্রচারে তেমন গুরুত্ব দিতে চাইছে না? রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কথা শুনে অবশ্য তেমন মনে হচ্ছে না। তিনি বলছেন, ‘‘আমরা যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, তারা কি শুধু শুধু মনে মনে ভক্তি প্রকাশ করি? মনে ভক্তি থাকলেও আমরা যেমন আনুষ্ঠানিক ভাবে আরাধ্য দেবতার পুজো করি, তেমনই ভোটের আগে গণদেবতার কাছেও যেতেই হয়। এটাই পরম্পরা।’’ ঠিকই। শাসক তৃণমূল তো প্রতি দিন তারকা প্রচারকদের নামের তালিকাও প্রকাশ করছে। হয়তো তাঁরা মমতা বা অভিষেকের পর্যায়ের ‘তারকা’ নন। কিন্তু বাবুল সুপ্রিয় থেকে ব্রাত্য বসু— তারকা তো বটে!
তৃণমূল সূত্রের খবর, রবিবার থেকে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার শুরু করবেন মমতা। উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে তাঁর একটি জনসভা হওয়ার কথা। পঞ্চায়েত ভোট ৮ জুলাই। ৬ জুলাই পর্যন্ত প্রচারের সময়সীমা রয়েছে। এই সময়কালে তৃণমূলের সব চেয়ে বড় তারকা মুখ্যমন্ত্রী আরও কিছু সভা করতে পারেন। অভিষেক তাঁর প্রায় দু’মাসে ‘তৃণমূলের নবজোয়ার কর্মসূচি’তে গোটা বাংলা ঘুরেছেন। তাতেও পঞ্চায়েত ভোটের জনসংযোগ অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। এখন দেখার, অভিষেকও দলনেত্রীর মতো বড় জনসভা করেন কি না।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটপ্রচার ছিল, আছে, থাকবেও। কিন্তু মঞ্চ বেঁধে নেতানেত্রীদের নিয়ে গিয়ে বড় বড় জনসভার দিন কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? পঞ্চায়েত নির্বাচনে এমনিতেই বড় সভা কম হয়। দিন দিন কি সেটাও কমছে?
তৃণমূল তারকা প্রচারকদের তালিকা দিলেও বিরোধীদের তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বস্তুত, রাজ্যের তিন প্রধান বিরোধী দলেরই শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, মানুষ সচেতন। সবাই সব জানেন। যা ঠিক করার করে ফেলেছেন। প্রচারের খুব একটা দরকার নেই। বরং, এই সময়টা ভোট এবং গণনার দিনের জন্য প্রার্থী থেকে নীচুস্তরের নেতা-কর্মীদের তৈরি করাটাই বড় কাজ।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘ডিজিটাল’ হওয়ার ব্যাপারে শহরের থেকেও এগিয়ে গ্রাম। — ফাইল চিত্র।
একটা সময়ে দেওয়াল দখল থেকে পর্যায়ক্রমে বাড়ি বাড়ি প্রচারের সঙ্গে রাস্তার মোড়ে পথসভা। বড় জনসভা তো ছিলই। পঞ্চায়েত ভোটে না হলেও বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে বড় সভা হত। কিন্তু দিন বদলেছে। মাইক ব্যবহারে বিধিনিষেধ এসেছে। প্রথমে ছাপা পোস্টার এবং পরে রঙিন ফ্লেক্স এসেছে। কিন্তু এখন সব ছাপিয়ে যাচ্ছে সমাজমাধ্যমে প্রচার। যা প্রতি দিনের। পয়সা খরচ করে (বুস্টিং) সেই প্রচার নির্দিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগও এসেছে। নেতারা যা রোজ করছেন।
পঞ্চায়েত ভোটে যাঁরা লড়াই করেন তাঁরা নিজেরা সেই প্রচার কতটা করতে পারেন, তা তর্কযোগ্য। কিন্তু তাঁদের নেতারা পারেন। বিষয়টা সহজ করে দিয়েছে সমাজমাধ্যম। হোয়াট্সঅ্যাপ, ফেসবুক, ইউটিউব জুড়ে সব সময়েই প্রচার হতে পারে। তথ্য বলছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘ডিজিটাল’ হওয়ার ব্যাপারে শহরের থেকেও এগিয়ে গ্রাম। সাধারণ বাজেটের আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ২০২২-’২৩ সালের যে আর্থিক সমীক্ষা সংসদে পেশ করেছিলেন, তাতে বলা হয়েছিল, শেষ ছ’বছরে ভারতের গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বেড়েছে ২০০ শতাংশ। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সেখানে শহরাঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫৮ শতাংশ। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৯ কোটি ৫৮ লাখের মতো। শহরাঞ্চলে ৯ কোটি ২৮ লাখের একটু বেশি। নির্মলা দাবি করেছিলেন, ডিজিটাল মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও শহরাঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে দেশের গ্রামাঞ্চল।
করোনাকালের পরে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনে কি সেই সময়ের অভ্যাসের কারণেই ডিজিটাল প্রচারের দিকে ঝুঁকেছে সব রাজনৈতিক দল? তবে প্রচারকে একেবারে তুলে দিতে চাইছেন না কেউ। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে বড় বড় সভা করার যতটা গুরুত্ব, পঞ্চায়েতে সেটা ততটা নেই। প্রতীক নিয়ে নির্বাচন হলেও আসলে এই ভোট হয় স্থানীয় সমীকরণের ভিত্তিতে। লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে নীতিভিত্তিক ভোট হয়। মানুষকে জানাতে হয় দল অর্থনীতি, বিদেশনীতি নিয়ে কী ভাবছে।’’
তবে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে তেমন প্রচার দরকার নেই বলেই মনে করছেন শমীকের দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘এখন রাজ্যের যা অবস্থা, তাতে ভোটাররা ইতিমধ্যেই সব কিছু ঠিক করে ফেলেছেন। কাকে সরাবেন, কাকে আনবেন, সব ঠিক হয়ে আছে মানুষের মনে মনে। সেটাই ব্যালট পেপারে প্রতিভাত হবে।’’ কিন্তু তা হলে তাঁরা ভোটের প্রচার করছেন কেন? সুকান্তের জবাব, ‘‘রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব প্রমাণের মাধ্যম প্রচার। সেই প্রচারে ভোটার যেমন আকৃষ্ট হন তেমনই কর্মীরাও চাঙ্গা হন। ভয় কমে।’’
পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সুকান্তের সঙ্গে অনেকটাই সহমত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, ‘‘এখন প্রচারের দরকার নেই। বরং কী ভাবে ভোট করতে হবে, কেমন করে ব্যালট বাক্স পাহারা দিতে হবে, কী ভাবে গণনাপ্রক্রিয়া চলবে, তার জন্য কর্মীদের তৈরি করা বেশি জরুরি।’’ তাঁর দাবি, এ বার গ্রামের মানুষ নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে একজোট।
কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যও মনে করছেন প্রচারের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গ্রামের মানুষ অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন। তাঁদের বুদ্ধিমত্তাও রয়েছে। এখন তো আর সেই দিন নেই। এক জন রাজনৈতিক নেতার জীবনশৈলী সম্পর্কেও সাধারণ মানুষ খোঁজ রাখেন। ভোটে সে সবেরও তো প্রভাব পড়ে। বক্তৃতায় কী শুনলামের থেকে আমি কী জানি, দেখেশুনে কী মনে হচ্ছে, সেটাই অগ্রাধিকার পায়।’’
তবে সব কিছুর শেষেও ভোটের আগে মানুষের কাছে যাওয়া চিরকাল থেকে যাবে বলেই মনে করেন প্রবীণ রাজনীতিক তৃণমূলের নির্বেদ রায়। তিনি বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে মানুষ সার্বিক নীতি নিয়ে ভাবে না। মানুষের চিন্তা থাকে আমার গ্রামে কী হচ্ছে বা কী হচ্ছে না। সেটা বলতে যেতে হয় ভোটপ্রার্থীদের।’’ পাশাপাশিই তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘মানুষ শুধু নেতাদের কথা শুনতে নয়, তাঁদের দেখতেও আসেন। এটা খুব বড় বিষয়। তাই যতই ডিজিটাল যুগ আসুক, প্রচার থেকে যাবে!’’