প্রতীকী ছবি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
প্রায় সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে, ‘‘বাড়িতে অসুখ আছে, মাফ করবেন।’’
গ্রামবাংলা থেকে মফস্বলে ভিখারিদের জন্য এমন বাক্যবন্ধ পরিচিত। খাস কলকাতার অনেক জায়গাতেও এমন চল রয়েছে। এ বার সেই একই কথা শুনতে হচ্ছে ‘ভোট ভিক্ষা’ চাওয়া রাজনৈতিক প্রার্থীদের। ছেঁড়া ছাতা আর রাজছত্রের পরিণতি একই।
তিনি বিজেপি প্রার্থী। দল চাইছে ভোট পিছিয়ে যাক। কিন্তু কী হবে, তার অপেক্ষায় তো আর বসে থাকা যায় না। তাই নিয়মিত প্রচারে বের হচ্ছেন। কিন্তু ভোট চাইবেন কার কাছে? সব দ্বারই যে রুদ্ধ!
তিনি তৃণমূল প্রার্থী। দল চাইছে কমিশনের ঘোষণামতো ২২ জানুয়ারি ভোট হয়ে যাক। তবে করোনা পরিস্থিতি যে হারে উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে, তাতে কী হবে কে জানে! কিন্তু বসে থাকা তো আর যায় না। তাই প্রচারে বের হচ্ছেন। কিন্তু সবটাই নিয়মরক্ষার।
শুনশান বিধাননগরের রাস্তাঘাট। বন্ধ দরজার ওপার থেকে বাসিন্দাদের আর্তি শোনা যাচ্ছে, ‘‘বাড়িতে করোনা। পরে আসবেন।’’ দলীয় কার্যালয়েও কর্মীদের দেখা নেই। সবাই আতঙ্কে। প্রার্থীও ভাবছেন, বেশি মেলামেশা করলে ভোটের দিন পর্যন্ত সুস্থ থাকা যাবে তো!
এমন অভিজ্ঞতাই শনিবার শোনা গেল সিপিএম এবং কংগ্রেস প্রার্থীদের মুখেও। আসলে বিধাননগরের অভিজাত পাড়াগুলোর ছবি এমনই। হালকা জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথায় ভুগছে বিধাননগরের বড় অংশ। করোনা কিংবা করোনা নয়— বিচার না করেই বাসিন্দারা সাবধানে থাকতে চাইছেন। বিধাননগরের বিডি ব্লকের বাসিন্দা সমর বিশ্বাস টেলিফোনে বললেন, ‘‘এখন দু'ধরনের মানুষ। একদল পরীক্ষা করিয়ে করোনা পজিটিভ। আর একদল পরীক্ষা না করিয়ে করোনা নেগেটিভ।’’
এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে ভোটের সজ্জায় বিধাননগর। তবে সে সাজে জৌলুস নেই। সে ভাবে প্রচারেই বেরচ্ছেন না অধিকাংশ প্রার্থী। ভাগ্য আর সংগঠনের উপরে ভরসা ছাড়া গতি নেই।
বিধাননগর পুরএলাকার মধ্যেই রয়েছে দত্তাবাদের মতো ঘনবসতি এলাকা। সেখানে করোনা নিয়ে ভয় আরও বেশি। তবে সে সব জায়গায় পতাকা, পোস্টারের উপস্থিতি অল্পবসতির এলাকা থেকে তুলনামূলক ভাবে বেশি। কিন্তু বিডি, ডিএল, সিএ-সহ অভিজাত এলাকাগুলির ছবি একেবারেই আলাদা। এক বিজেপি প্রার্থী যেমন বললেন, ‘‘শেষবার বাড়ি বাড়ি প্রচারের চেষ্টা করেছিলাম গত রবিবার। পর পর তিনটে বাড়িতে কলিং বেল বাজাতেও দরজা খুলল না। উপরতলার কোনও একটি জানলা আধখানা খুলল। আড়াল থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর— ‘বাড়িতে আমরা সবাই করোনা আক্রান্ত। পরে আসবেন।’ একটি বাড়িতে বলা হল, ‘আমরা কেউ ভোট দেব না। মাফ করবেন।’ শুনে চলে এলাম। তার পর আর যাইনি।’’
ভোটের প্রচার বন্ধ করে দিয়েছেন বিধাননগরের তারকাপ্রার্থী সব্যসাচী দত্তও। প্রাক্তন মেয়র গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হলেও এ বার ৩২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তৃণমূল প্রার্থী। শনিবার তিনি বললেন, ‘‘প্রচারে বেরিয়ে মার খাব না কি! তা ছাড়া লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংক্রমণ ছড়ানোও তো ঠিক নয়। আমি সুস্থ। কিন্তু ভয়ে পরীক্ষা করাচ্ছি না। যদি রিপোর্ট পজিটিভ আসে!’’
এই পরিস্থিতিতে কি ভোট হওয়া সম্ভব? ডিএল ব্লকের বাসিন্দা সব্যসাচীর কৌশলী জবাব, ‘‘এ নিয়ে কিছু বলব না। ওটা কমিশনের বিষয়। তবে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে বেরতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। যদিও এখন যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা সুস্থও হচ্ছেন তাড়াতাড়ি। ১০ তারিখ পর্যন্তও যাঁরা আক্রান্ত হবেন, তাঁরা ভোটের আগে সুস্থ হয়ে যাবেন। আমি অবশ্য চাই সাধারণ মানুষ এখন থেকেই সংক্রমণ থেকে দূরে থাকুন।’’
সাধারণ মানুষ যে ভোট দিতে বেরবেন না, নিয়ে একেবারে নিশ্চিত বিজেপি-র রাজ্য নেতা শমীক ভট্টাচার্য। বিধাননগরের বিএইচ ব্লকের বাসিন্দা শমীক বলেন, ‘‘আমি তো বারবার বলছি, এই পরিস্থিতিতে ভোট করা সম্ভব নয়। এমনিতেই বিধাননগরে ভোটের ইতিহাস বলছে, বাসিন্দারা বুথবিমুখ। আর এখন তো প্রচারই করা যাচ্ছে না! তার উপর বিধাননগরের বাসিন্দারা এতটাই উদ্বেগে, যে তাঁরা বাড়ি থেকে পারতপক্ষে বের হচ্ছেন না। রাজ্য সরকার তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও সকলকে বাড়িতে থাকতে বলছেন। তা হলে ‘ভোট দিতে আসুন’ বলা যাবে কী করে?’’
যদিও পরিস্থিতি যেমনই থাকুক, নিজের ভোটটি দিতে চান শমীক। তাঁর কথায়, ‘‘একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ভোট দিতে তো যাবই। তবে সেই সময়ে সুস্থ থাকব কি না সেটা জানি না।’’ একই রকম কথা বক্তব্য রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বিধাননগরের বাসিন্দা সিপিএম নেতা সৌমেন্দ্রনাথ বেরা। এফডি ব্লকের বাসিন্দা সৌমেন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘নির্বাচন হলে ভোট দিতে তো যাবই। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, নাগরিক হিসেবে এটা তো কর্তব্য। তবে তার আগে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সবরকম নিরাপত্তা নিতে হবে।’’