জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। —ফাইল চিত্র।
শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীলই রয়েছে ইডির হাতে ধৃত প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী তথা বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের। রবিবার বুলেটিন প্রকাশ করে সে কথা জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল সূত্রে খবর, সোমবার বালুর (রাজ্য-রাজনীতিতে এই নামেই বেশি পরিচিত) হৃদ্যন্ত্রের কিছু পরীক্ষাও করা হতে পারে। আবার সোমবারই ব্যাঙ্কশাল আদালতে (ইডির অবকাশকালীন আদালত) মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থার রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার। অন্য দিকে, ইডি সূত্রে দাবি, রেশন দুর্নীতি মামলায় ধৃত জ্যোতিপ্রিয় এবং বাকিবুর রহমানের ‘ঘনিষ্ঠ’ অনেকের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান এবং তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তথ্য হাতে এসেছে। আপাতত গোয়েন্দাদের আতশকাচের তলায় রয়েছে অন্তত দু’ডজন মোবাইল ফোন এবং এক ডজন সংস্থা!
বাকিবুরকে আগেই গ্রেফতার করেছিল ইডি। তারা আদালতে জানিয়েছে, রেশন ‘দুর্নীতি’র অন্যতম মূল চক্রী বাকিবুরের বয়ানের ভিত্তিতে মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়াও ইডির তদন্তকারীরা বর্তমান আপ্ত-সহায়ক অমিত দে এবং প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক অভিজিৎ দাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ইডি সূত্রের দাবি, ওই দু’জন ছাড়াও মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ আরও কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বা হবে। তাঁদের মধ্যে দমদমের এক কাউন্সিলরও আছেন। তাঁকে শনিবার ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ওই কাউন্সিলরের সঙ্গে মন্ত্রীর দীর্ঘ দিনের ‘ঘনিষ্ঠতা’ রাজনৈতিক মহলে সুবিদিত। বৃহস্পতিবার অমিতের দু’টি ফ্ল্যাট এবং অভিজিতের হাওড়ার ব্যাঁটরার বাড়িতেও তল্লাশি হয়েছিল। ইডি সূত্রের দাবি, অভিজিতের বাড়ি থেকে একটি মেরুন রঙের ডায়েরি মিলেছে এবং সেই ডায়েরি থেকেই ‘বালুদা’-র বিভিন্ন লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, বাকিবুর-সহ বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করা হত এবং সেই টাকা মন্ত্রীর কাছে পৌঁছত। আগে বাকিবুরের শ্যালক অভিষেক বিশ্বাসের ফ্ল্যাটেও তল্লাশি চালিয়েছে ইডি।
ইডি সূত্রের খবর, বাকিবুর এবং জ্যোতিপ্রিয় ছাড়াও এই ‘দুর্নীতি’কাণ্ডে যাঁদের নাম জড়িয়েছে, তাঁদের মোবাইল ফোনগুলি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। মন্ত্রীর দু’টি মোবাইল ফোন ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে। ফরেন্সিক পরীক্ষা করা হবে এই মামলায় ধৃত ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমানের মোবাইল ফোনেরও। ইডি সূত্রের দাবি, বাকিবুরের সঙ্গে মন্ত্রীর একাধিক বার্তালাপ (চ্যাট) উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যাচাইয়ের জন্য ফরেন্সিক পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, দু’দফায় জ্যোতিপ্রিয়কে মোট ৮০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। গোয়েন্দাদের ওই সূত্রেরই দাবি, বাকিবুরের তরফে জনৈক ‘এমআইসি’কে টাকা দেওয়ার তথ্যও হাতে এসেছে। ইডির দাবি, এই ‘এমআইসি’-র অর্থ ‘মিনিস্টার ইন চার্জ’ অর্থাৎ ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তিনি আর কেউ নন, খোদ জ্যোতিপ্রিয়। এই সূত্র ধরেই ওই দু’ডজন ফোনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে বলেই মনে করছেন তদন্তকারীরা।
তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থা খুলে রেশন বণ্টন ‘দুর্নীতি’র টাকা অন্য নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা হয়েছে। মূলত শেয়ার কেনাবেচার জন্যই সংস্থাগুলি খোলা হয়েছিল। ওই সংস্থাগুলির মধ্যে বেশ কিছু সংস্থায় প্রাক্তন ডিরেক্টর ছিলেন মন্ত্রীর স্ত্রী এবং কন্যা। বেশ কিছু সংস্থার কাজকর্ম আবার বন্ধও করে দেওয়া হয়। এই বিষয়ে সবিস্তারে তথ্য পেতে খোঁজখবর চালাচ্ছেন আধিকারিকেরা। রেশনের গম এবং আটা খোলা বাজারে বিক্রি নিয়ে কখনও ফোনে কথোপকথন হয়েছে কি না এবং হলে কাদের সঙ্গে হয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখার চেষ্টা চলছে। ইডি সূত্রের দাবি, বাকিবুরের সঙ্গে জ্যোতিপ্রিয়ের ‘পারিবারিক সম্পর্ক’-এরও হদিস মিলেছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, দুই পরিবারের সদস্যেরা একযোগে একাধিক সংস্থা চালাতেন। ওই সব সংস্থা আবার বিভিন্ন ভুয়ো সংস্থায় কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগও করত বলেও অভিযোগ রয়েছে!
ইতিমধ্যেই তিন সংস্থার নাম প্রকাশ্যে এসেছে। সেগুলি হল— ‘শ্রী হনুমান রিয়েলকন প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘গ্রেসিয়াস ইনোভেটিভ প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘গ্রেসিয়াস ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড’। ইডির সূত্রের দাবি, তিন সংস্থার মারফত ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হয়েছে অন্তত ১২ কোটি টাকা। ইডির সূত্রের দাবি, প্রত্যেকটি সংস্থাতেই কোনও না কোনও ভাবে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় এবং বাকিবুরের পরিবারের যোগ রয়েছে। তদন্তকারীদের একাংশের এ-ও দাবি, জ্যোতিপ্রিয়ের পরিবারের সদস্যদের সংস্থার সঙ্গে তাঁর আর্থিক লেনদেন হয়েছিল বলে জেরায় কবুল করেছেন বাকিবুর।
এই সংস্থা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শনিবারই মুখ খুলেছেন মন্ত্রীর প্রাক্তন জামাই অভ্র সেন। তাঁর অভিযোগ, নিজের স্ত্রী এবং মেয়ের পাশাপাশি বাড়ির এক পরিচারককেও ওই সংস্থার ডিরেক্টর করেছিলেন মন্ত্রী। ইডি সূত্রের দাবি, গোড়ায় জ্যোতিপ্রিয়ের স্ত্রী এবং মেয়ে সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁরা সরে গেলে বাড়ির এক পরিচারক এবং আর এক ঘনিষ্ঠকে সংস্থার ডিরেক্টর করা হয়। মন্ত্রীর ওই পরিচারক রাজ্য কৃষি দফতরের কর্মী বলেও তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। টাকা লোপাটের ক্ষেত্রে এই ধরনের সংস্থা বিশেষ হাতিয়ার হয় বলে তদন্তকারীদের দাবি। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের সংস্থার মাধ্যমে টাকা লোপাট ছাড়াও বহু ক্ষেত্রেই সিনেমা, সিরিয়ালে টাকা বিনিয়োগ করতেও দেখা গিয়েছ।
ইডি সূত্রের দাবি, বাকিবুরের আরও কিছু সম্পত্তির হদিস মিলেছে। আগে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছিলেন, তাঁর পার্ক স্ট্রিট, নিউ টাউন-রাজারহাট এলাকায় ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া আরও একাধিক জায়গায় আট-ন’টি ফ্ল্যাটের হদিস মিলেছে। বিভিন্ন সংস্থায় বাকিবুরের শেয়ারও রয়েছে। এমন মোট ছ’টি সংস্থার কথা জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। কেন্দ্রীয় সংস্থা সূত্রে জানা যায়, ওই ছ’টি সংস্থায় বাকিবুরের শেয়ারের পরিমাণ সাড়ে ৫০ কোটি টাকারও বেশি।
মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা কেমন
শুক্রবার রাত থেকে ইএম বাইপাসের ধারের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জ্যোতিপ্রিয়। তাঁকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছিল। রবিবার হাসপাতাল জানিয়েছে, মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল। ডায়াবেটিক রোগীরা সাধারণত যে খাবার খেয়ে থাকেন, তা-ই খাচ্ছেন জ্যোতিপ্রিয়। রবিবার তাঁর হল্টার মনিটরিং করানো শেষ হয়েছে। এটি হৃদ্যন্ত্রের একটি দীর্ঘ পরীক্ষা। এর মাধ্যমে হৃদ্স্পন্দনের মাত্রা বোঝা যায়। রবিবার আবার তাঁর মস্তিষ্ক এবং সার্ভাইক্যাল স্পাইনের এমআরআই করানো হয়েছে। জ্যোতিপ্রিয়কে পরীক্ষা করে দেখেছেন বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকেরা। দেখা গিয়েছে, তাঁর বাঁ হাত এখনও সামান্য দুর্বল। রবিবার বিকেলে হাসপাতালে গিয়েছিলেন ইডির আধিকারিকেরা। ইডি সূত্রে খবর, মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। কারণ, সোমবারই তাদের আদালতে সেই রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। রেশন দুর্নীতি মামলায় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জ্যোতিপ্রিয়কে গ্রেফতার করেছে ইডি। তার আগে প্রায় ২০ ঘণ্টা ধরে তাঁর সল্টলেকের দু’টি ফ্ল্যাটে চলে ম্যারাথন তল্লাশি। রাতে মন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয় সিজিও কমপ্লেক্সে। তার পরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। শুক্রবার হাজির করানো হয় আদালতে। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে সেখান থেকে বাইপাসের ধারের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত মন্ত্রীকে ১০ দিনের ইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে ১০ দিন তাঁকে থাকতে হবে ইডির হেফাজতে। হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার খরচ বহন করবে পরিবার। হাসপাতালে সিআরপিএফ মোতায়েন রয়েছে। মন্ত্রীর চিকিৎসার জন্য জেনারেল মেডিসিন, কার্ডিয়োলজি ও নেফ্রোলজির চিকিৎসকদের নিয়ে তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। শনিবারই চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মন্ত্রীর ডায়াবিটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। সেই কারণে তাঁর রক্তে শর্করার মাত্রা অনেক বেশি। কিডনির সমস্যাও রয়েছে। মন্ত্রীর শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রা ঠিক নেই এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় তাঁকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে আনা হয়। প্রাথমিক ভাবে নিজের পছন্দের হাসপাতালে পাঠানো হলেও পরে আদালতের বলে দেওয়া হাসপাতালেই পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে মন্ত্রীকে।
হঠাৎ ইডি দফতরে মন্ত্রী-কন্যা
মন্ত্রী যখন হাসপাতালে, তখন রবিবার দুপুরে তাঁর কন্যা প্রিয়দর্শিনী মল্লিক হঠাৎই পৌঁছে যান সল্টলেকের ইডি দফতরে। কয়েক মিনিট পর সেখান থেকে বেরিয়েও যান তিনি। কিন্তু প্রিয়দর্শিনী কেন ইডি দফতরে গিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তাঁর হাতে একটি ফাইল দেখা গিয়েছে। তাতে কিছু কাগজপত্র ছিল। কাগজ জমা দিতেই কেন্দ্রীয় সংস্থার দফতরে প্রিয়দর্শিনী গিয়েছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। রবিবার দুপুর ১টার পরে প্রিয়দর্শিনী সিজিও কমপ্লেক্সে পৌঁছন। তাঁর কাঁধে একটি ব্যাগ ছিল। হাতে ছিল একটি ফাইল। তাতে কী কাগজ রয়েছে, প্রিয়দর্শিনী সেই প্রশ্নের জবাব দেননি। তাঁকে ইডি তলব করেছিল কি না, কোনও নথিপত্র নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল কি না, সব প্রশ্নের জবাবেই নীরব ছিলেন মন্ত্রীকন্যা। ইডি দফতরে পৌঁছে তিনি লিফ্টে উঠে যান। কয়েক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এসে আবার গাড়িতে উঠে যান।