অতিমারির পরে, দশচক্রে কেমন কাটছে গ্রাম-জীবন, ঘুরে দেখা পরিকাঠামোর হাল। আজ পানীয় জল।
Drinking water

জলে আশ্বাসই সার, বসলেও শুকনো থাকে অধিকাংশ কল

উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ ছেড়ে দিলে দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার দোরগোড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে বাংলার আর্সেনিক কবলিত এলাকা, যেখানে পরিস্রুত পানীয় জল দিতে না পারা বিপজ্জনক।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৩ ০৬:২৬
Share:

২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এই রাজ্যের শাসক দলের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল, গাঁয়ের ঘরে-ঘরে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া। প্রতীকী ছবি।

কারও সাইকেলের পিছনে জলের জার, কারও ছোট ড্রাম। ওঁরা চলেছেন কিলোমিটার দুই দূরে, পাশের গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পানীয় জল আনতে।

Advertisement

এটা ওঁদের নিত্যদিনের হ্যাপা। শুধু জার-ড্রাম নিয়ে চলে গেলেই তো হল না। যাদের এলাকা তারাই বা অফুরন্ত জল নিতে দেবে কেন? এ কি ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’ নাকি! অতএব নিত্য ঝগড়া-অশান্তি লেগেই আছে।

ওঁদের বাড়ি চাকদহ ব্লকের দেউলি পঞ্চায়েতের নারায়ণপুর গ্রামে, অনেক আগেই যেখানে বাড়ি-বাড়ি নলবাহিত পানীয় জলের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাসের পর মাস যায়, কলে জল আর আসে না। দেখে-দেখে ক্রমশ ওঁদের মালুম হয়েছে— নল, কল আর জল সমার্থক নয়।

Advertisement

ঘটনাচক্রে, দেউলি গ্রাম পঞ্চায়েত যে জেলায়, সেই নদিয়া রাজ্যে পানীয় জলের সংযো‌গ দেওয়ায় এক নম্বরে রয়েছে। কাজ শুরু না-হওয়া লক্ষদ্বীপকে বাদ দিলে জাতীয় তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে তালিকার একেবারে নীচে। জাতীয় গড় যেখানে ৬০ শতাংশ ছুঁতে চলেছে, এ রাজ্য এখনও ৩২ শতাংশের নীচে আটকে রয়েছে। নদিয়াই রাজ্যের একমাত্র জেলা, যেটি লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ পেরোতে পেরেছে।

রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানে থাকা শুখা জেলা বাঁকুড়া রয়েছে ৪৮ শতাংশের আশপাশে। সেখানকার ছবিটা কেমন? রানিবাঁধের হলুদকানালি পঞ্চায়েতের মালবেড়া গ্রামের দুলালি মাহাতোর আক্ষেপ, কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁদের বাড়ির পাইপলাইনে জল দেওয়া বন্ধ। ব্লক অফিসে দৌড়েও সুরাহা হয়নি। পাশের দুই জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর আর পুরুলিয়া রয়েছে তালিকার তলানিতে, তাদের অবস্থা আরও খারাপ।

এই যে হিসাব, সবই কল পৌঁছনোর। জলের নয়। সেই হিসাবেও গুজরাত যেখানে পুরো কাজ সেরে ফেলেছে, বাংলা রয়েছে বহু যোজন দূরে। এ রাজ্যে আবার কার্যত এক প্রকল্প চলেছে দুই নামে— কেন্দ্রের ‘জল জীবন মিশন’, রাজ্যের দেওয়া নাম ‘জলস্বপ্ন’। অংশীদারি সমান-সমান। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এই রাজ্যের শাসক দলের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল, গাঁয়ের ঘরে-ঘরে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া। তা এখনও বহু দূর।

উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ ছেড়ে দিলে দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার দোরগোড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে বাংলার আর্সেনিক কবলিত এলাকা, যেখানে পরিস্রুত পানীয় জল দিতে না পারা বিপজ্জনক। এই মানচিত্রে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনার বেশির ভাগ এলাকা ছাড়াও রয়েছে পূর্ব বর্ধমান, হুগলি ও হাওড়ার অনেকখানি। এর মধ্যে নদিয়া বাদে শুধু পূর্ব বর্ধমানে সংযোগ দেওয়ার কাজ ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বাকি প্রায় সব জায়গাতেই কাজ হয়েছে ২০ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে। বেশ কিছু ব্লকের অনেক এলাকায় পানীয় জলের তেমন ব্যবস্থা নেই। বেআইনি জলের কারখানাও গজিয়ে উঠেছে প্রচুর। দক্ষি‌ণ ২৪ পরগনার পরিস্থিতিও প্রায় একই।

এই তালিকার একেবারে নীচে রয়েছে মালদহ, যেখানে কাজ ২৫ শতাংশেরও নীচে। সেখানকার পরিস্থিতি গোটা উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। দার্জিলিঙের অবস্থাও প্রায় উনিশ-বিশ। দার্জিলিং ও কালিম্পং পাহাড়ে জলের সমস্যা বস্তুত বহু দশকের। বাম আমলে পাহাড়ের জল সমস্যা মেটাতে বালাসন প্রকল্পের ঘোষণা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আজও সোনাদা, সুখিয়াপোখরি থেকে লেবং, আলগাড়ার রাস্তায় ঝোরায় ভরা জলের ড্রাম টয়ট্রেনের লাইন ধরে চাকা লাগানো পাটাতনে বসিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়। উত্তরবঙ্গে ৪০ শতাংশের বেশি সংযোগ দেওয়ার কাজ হয়েছে একমাত্র আলিপুরদুয়ারে।

চৈত্রের শুরুতেই তেতে উঠতে শুরু করেছে ছোটনাগপুর মালভূমি ঘেঁষা রাজ্যের পশ্চিমাংশ। গরম যত বাড়ছে, জলস্তর তত নামছে। যেখানে জল যায়, সেখানেও জলের চাপ কমে যাচ্ছে। পুরুলিয়ার মানবাজারে রাস্তার কলের জলই বহু মানুষের সম্বল। সেই জলের চাপ কমে যাওয়ায় পথ অবরোধ হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামে বহু গ্রামের বাসিন্দাদেরই অনেক দূরে গিয়ে জল আনতে হচ্ছে। বীরভূমের নানা এলাকায় দিদির সুরক্ষা কবচ কর্মসূচিতে গিয়ে পানীয় জল নিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তৃণমূলের সাংসদ ও বিধায়কেরা।

রাঢ়বঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংযোগ দেওয়া হয়েছে বাঁকুড়ায়। সেখানেও বিষ্ণুপুরের রাধানগরের বাসিন্দাদের আক্ষেপ, দেড় বছর ধরে অধিকাংশ বাড়িতে জল আসছে না। জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর মেনে নিচ্ছে, বেশি সংযোগ দেওয়ায় জলের চাপ কমে গিয়েছে। ভোটের মুখে নতুন পাইপ বিছিয়ে জলের চাপ বাড়ানো হবে বলে আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে।

২০২৪ সালের মধ্যে সব ঘরে জল দেওয়ার স্বপ্ন ফিরি করছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। কিন্তু শুধু পাইপলাইন বি‌ছিয়ে দিলেই তো কাজ মিটবে না। সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে জল তোলা, পরিশোধন ও পর্যাপ্ত জলাধারে তা সঞ্চিত রাখার যে বিপুল পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার, তা হতে এখনও বিস্তর কাঠখড় পোড়ানো বাকি। প্রাকৃতিক বাধা তো আছেই, রাজনৈতিক বিরোধও উপরি বিপদ।

আপাতত, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এ রাজ্যের ঘরে-ঘরে জল তাই শুধুই স্বপ্ন!

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement