ক্যামেরা, লাইট্স, সাউন্ড— অ্যাকশন।
এ সব তো জানা ছিল। জানা ছিল আরও। যেমন, একটা ছবি শুট করতে গেলে তার স্ক্রিপ্ট থাকবে। থাকবেন পরিচালক। কলাকুশলী। থাকবে একটা গোটা ইউনিট। কিন্তু, ডায়েরিটা খুলেই চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল এক পুলিশ কর্তার। সেখানে পাতার পর পাতায় তালিকার মতো করে লেখা বিভিন্ন চরিত্রের নাম। যেমন অফিসের বস-সেক্রেটারি, জামাই-শাশুড়ি, শালি-জামাইবাবু, হানিমুন কাপল। আর চরিত্রের নীচে সে সম্পর্কে অল্প কয়েকটি শব্দে ছোট করে নোট। দেখে বোঝার উপায় নেই, সেগুলি আসলে এক একটা স্ক্রিপ্ট।
ডায়েরি লেখক এক জন চলচ্চিত্র পরিচালক। পুলিশ কর্তার প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাঁরই নির্দেশনায় ওই স্ক্রিপ্ট থেকে শুটিং চলছিল। কোথায় চলছিল শুটিং? খাস সল্টলেকে। অতি পরিচিত এক বিয়েবাড়ি ভাড়া করে। বাড়ির মালিক-সহ গোটা টিমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কারণ, যে সে ছবি নয় ওঁরা নীল ছবির শুটিং করছিলেন। সল্টলেকে নীল ছবি? অবাক হবেন না। শুধু সল্টলেক নয়, কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গাতে এমন ছবির শুটিং হওয়াটা নাকি আকছার ঘটনা। শুধু কলকাতা নয়, রাজ্যের বেশ কিছু জায়গাতেই হয় এমন শুটিং। পুলিশ কর্তাদের একাংশের এমনই দাবি।
অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কারা?
পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যারা ব্লু-ফিল্মে কাজ করেন তাঁদের বেশির ভাগেরই অন্য পেশা রয়েছে। গোয়েন্দা দফতরের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, শতাংশের হিসেবে খুব কম হলেও গৃহবধূরাও আসেন এই পেশায়। বাড়তি আয় তো বটেই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মজা নিতেই অনেকে ‘অভিনয়’ করতে চলে আসেন। অন্য এক পুলিশ অফিসার জানাচ্ছিলেন, বেশ কিছু দিন ধরেই তাঁরা অভিযোগ পাচ্ছিলেন কলকাতার একটি নামী কলেজের বেশ কিছু ছাত্রী কলেজে আসার কিছু ক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দিন নানা সময়ে। কিন্তু, কোথায় যায়, কেন যায় সে ব্যাপারে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। অভিযোগ পেয়ে খোঁজখবর করতেই জানা গেল, তারা শহরের একটি অভিজাত এলাকায় এক ফ্ল্যাটে যায়। পরে অভিযান চালিয়ে জানা যায়, ওই ফ্ল্যাটে ব্লু-ফিল্মের শুটিং হত। কলেজছাত্রীদের পাশাপাশি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে কল সেন্টার কর্মী, এমনকী থিয়েটার শিল্পীও— নানা পেশার ভিড় জমেছে এখন ব্লু ফিল্মের দুনিয়ায়। বয়স যত কম, নির্মাতাদের কাছে তাঁর চাহিদা তত বেশি। দেখতে সুন্দর হওয়ার পাশাপাশি আবেদনের উন্নত মাত্রাবোধও এ ক্ষেত্রে বিচার্য। কাজ পাওয়ার জন্য এগুলি অগ্রাধিকার পায়। শুধু কাজ পাওয়া নয়, পারিশ্রমিকও সেই হিসেব করেই হয়। বয়স কিন্তু তাদের ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যেই।
নীল ছবির শুটিং-এ গ্রেফতার হওয়া এক তরুণী পুলিশের কাছে জানিয়েছেন, তিনি পেশায় থিয়েটার কর্মী। মফস্সলের একটি নাট্যদলে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি সিনেমাতেও কাজ করতে চেয়েছিলেন। খোঁজখবর করতে করতে যোগাযোগ হয় এক জনের সঙ্গে। তিনিই সিনেমার নাম করে নীল ছবিতে নামান ওই তরুণীকে। টাকাপয়সা মন্দ নয়। প্রতি দিনের হিসেবে কাজ করলে প্রায় হাজার আড়াই টাকা পারিশ্রমিক মেলে। আর ঘণ্টাকয়েকের কাজ শেষে ফিরে যাওয়া যায় থিয়েটারের আশ্রয়ে।
তবে নির্মাতাদের চোখ থাকে সব সময় তরুণ মডেলদের দিকে। মডেলিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া ছেলেমেয়েদের অনেকের কাছেই প্রস্তাব আসে নীল ছবির। টলিউডে পেশা শুরু করা এক তরুণ অভিনেতা কেরিয়ারের প্রথম দিকে এমন প্রস্তাব পেয়েছিলেন। দিঘা এবং শঙ্করপুরের হোটেলে কাজ করার প্রস্তাব মেলে। সেই তরুণের তখন পারিশ্রমিক ছিল দৈনিক হাজার টাকা। নীল ছবি তাঁকে দিন প্রতি পাঁচ হাজারের হাতছানি দিয়েছিল। কিন্তু, কোনও কারণে সেই প্রস্তাবে রাজি হতে পারেননি তিনি। কারণ ওই ছবি ইউটিউবে ছাড়া হবে বলে তাকে জানানো হয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রির লোকজন জানতে পারলে কেরিয়ারের শুরুটাই নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে তিনি আর এগোননি।
এই সংক্রান্ত খবর: নীল ছবির শ্যুটিঙের অভিযোগে সল্টলেকে গ্রেফতার ২৮
অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এক একটা ক্লিপের জন্য দেড় থেকে তিন হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক পান। দিনে অনেকে দু’-তিনটে ক্লিপে অভিনয় করেন। পুলিশের দাবি সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকেই অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আসেন। সচ্ছল পরিবারের পাশাপাশি দরিদ্র পরিবার থেকেও অনেকে এই ছবিতে কাজ করেন। এমনকী, কলেজ পড়ুয়ারাও শুধুমাত্র হাতখরচার জোগান বাড়াতে নীল ছবির দুনিয়ায় পা রাখছে। পুলিশের সূত্রটি জানাচ্ছে, অনেক সময় না জেনেও কেউ কেউ এই পেশায় পা দিচ্ছেন। তাঁদের বলা হচ্ছে টেলি ফিল্মের কাজ হবে, অথচ কাজে নেমে তিনি দেখলেন পোশাকহীন হয়েই অভিনয় করতে হচ্ছে। টাকা নিয়েছেন বলে, কাজ শেষ করতেও হচ্ছে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে। এমনটাও অনেকে জানিয়েছেন পুলিশি প্রশ্নের মুখে।
কেমন ভাবে তৈরি হয় নীল ছবি?
বাকি অংশ পড়তে ২-এ ক্লিক করুন
আর পাঁচটা ছবির মতো করেই তৈরি হয় পর্ণ চিত্র। শুরুটা হয় লোকেশন বাছার কাজ দিয়ে। কোনও বাড়িতে বা রিসর্টে এর মূল কাজটা হয়। কাজ শুরুর আগে পরিচালক গোটা এলাকাটা রেকি করে আসেন। যেখানে শুটিং হবে, তার আশপাশের বাড়ি-ঘরদোর এমনকী মানুষ জনের কাজের ধরণও জরিপের মধ্যেই পড়ে। খুব শব্দপ্রবণ এলাকা বাছা হয় না। কারণ, রেকর্ডিং-এর সময় ‘অবাঞ্ছিত’ আওয়াজ শিল্পীদের মূলত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। পাশাপাশি প্রতিবেশীরা যদি শুটিং-এর ব্যাপারে খুব উত্সাহী হয়ে পড়েন তবে মূল কাজটিই তো হবে না। সুতরাং অতি ব্যস্ত অথবা এক্কেবারে নির্জন এলাকার বাড়ি-রিসর্ট বাছা হয়। সল্টলেক সব দিক থেকেই নিরাপদ। শুধু সল্টলেক নয়, রাজারহাট, নিউটাউনের পাশাপাশি কলকাতারও কিছু এলাকা নীল ছবির ইউনিটের কাছে প্রিয় তার স্বভাবের কারণেই।
ইদানীং পর্ণ সাইটগুলির রমরমা বেশ। অনলাইন চ্যানেলেও ভিডিও আপলোড করে দেওয়া যায়। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পারিশ্রমিকের একটা অংশ প্রাথমিক ভাবে দিয়ে দেওয়া হয়। পরে, দর্শক মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বিচার করে মানে ইউটিউবে ওই ভিডিওতে কতগুলি হিট বা লাইক পড়ল তার উপর নির্ভর করে একটা পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে টাকার অঙ্কটা মন্দ নয় বলে জানালেন এক পুলিশ কর্তা। তাঁর দাবি, মূল ব্যবসার ১৫ শতাংশ টাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পেয়ে থাকেন।
শুধু কলকাতা নয়, শিলিগুড়ি, দিঘা, মেদিনীপুর, বহরমপুর, জলপাইগুড়ি, বারুইপুর, সোনারপুর, ডায়মন্ডহারবার— জায়গার নাম অসংখ্য। প্রতিটা জায়গায় এখন রমরম করে চলছে নীল ছবির শুটিং। অনেক সময়ে পুলিশ জানতেই পারে না। চোরাগোপ্তা ভাবে শুটিং সেরে ফিরে যায় গোটা ইউনিট। সম্প্রতি ডুয়ার্সের চালসার কাছে টিয়াবনে এ রকম শুটিং-এর খবর পেয়ে পুলিশ ওই রিসর্টে অভিযান চালিয়েছিল। সেখান থেকে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটা বড় অংশ সে ক্ষেত্রে নেপালি ছিলেন। তবে, সল্টলেকে গ্রেফতার হওয়া অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রত্যেকেই বাঙালি। বয়স তাঁদের ২২ থেকে ৩৫। পুলিশের দাবি, অনলাইনে আপলোড করার জন্য ওই শুটিং করা হচ্ছিল। ধৃতদের মধ্যে কলকাতা ও শহরতলী ছাড়াও শিলিগুড়ি থেকেও ছেলেমেয়েরা এসেছিল। নীল ছবিতে অভিনয় করে টাকা রোজগার করার মধ্যে এঁদের অনেকেই অন্যায়ের কিছু দেখেন না। পুলিশের একটা সূত্র বলছে, এক বার ধরা পড়ার পর ফের তারা ওই চক্রের মধ্যে ফের ঢুকে পড়ে। আবার শুটিং, আবার টাকা। তবে কেউ কেউ যে শুধুমাত্র বিনোদনের টানেই যে অভিনয় করতে আসেন না, তেমনটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন এক পুলিশ কর্তা।
বাকি অংশ পড়তে ৩-এ ক্লিক করুন
ডায়েরির পাশাপাশি ক্যামেরা এবং কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক উদ্ধার হয়েছে সল্টলেকে গ্রেফতার হওয়া ওই শুটিংস্থল থেকে। সেই হার্ড ডিস্কে প্রায় ৫০টি ভিডিও ক্লিপ পাওয়া গিয়েছে। আন এডিটেড সেই ভিডিওগুলি এখন পুলিশি হেফাজতে রয়েছে। ডায়েরির পাতায় লিখে রাখা স্ক্রিপ্টের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়, ৫৬। কাজেই একটা টিম যদি এমন শতাধিক ছবির প্ল্যান করে, যার পঞ্চাশটির শুটিংও শেষ, তা হলে এই কলকাতাতেই তো আরও অনেক নীল টিম রয়েছে। পুরো সংখ্যাটা ভেবে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়েছে পুলিশ কর্তাদের।