কলকাতার সেন্ট পল্’স চার্চ। ছবি:শাটারস্টক।
ব্যস্ততম রাস্তা। বড়বাজার, ব্রেবোর্ন রোডের ভিড়। মুটেওয়ালাদের হাঁকডাক। ত্রিপল খাটিয়ে চলা দোকানপাট। কলকাতা-হাওড়াগামী বাস, ট্যাক্সির ভিড়। এমনই জায়গায় রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন আর্মেনিয়ান গির্জা। সে জায়গায় যেতে হলে সঠিক গলি খুঁজতে গিয়ে শীতেও কপালে ঘাম জমতে পারে। কলকাতা এমনই। ভিড়ে ঠাসা এই শহরের আনাচকানাচে ছড়িয়ে কত না স্থাপত্য! পাশ দিয়ে বেখেয়ালে যেতে যেতে কদাচিৎ দৃষ্টি পড়ে সেখানে। বোঝা যায়, কত কিছুই না রয়ে গিয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে।
এই শহরের আনাচকানাচে ছড়িয়ে তেমনই গুটি কয়েক চার্চ। অনুমান করা হয় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা এ দেশে আসার পর থেকেই উপাসনার জন্য তৈরি হয়েছিল প্রার্থনাকক্ষ। তবে ইংরেজরা এ দেশে আসার অনেক আগেই খ্রিস্টধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ান ও পর্তুগিজেরা বাংলায় এসেছিল। বিভিন্ন সময়ে তাঁদের প্রার্থনাকক্ষের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে গির্জা। ঠিক সে কারণে এই শহরের আনাচকানাচে রয়েছে একাধিক গির্জা। স্বাভাবিক ভাবেই, আর্মেনীয়, পতুর্গিজ, ব্রিটিশদের তৈরি করা সেই গির্জাগুলির স্থাপত্যশৈলীতেও বৈচিত্র চোখে পড়ে।
এমনিতে বছরভর সে দিকে বড় একটা চোখ যায় না। কিন্তু যিশুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভোল পাল্টায় গির্জাগুলির। কোনওটিতে পড়ে রঙের পোচ। সেজে ওঠে আলোকমালায়। তখনই দৃষ্টি পড়ে সকলের। মনে হয়, এই রাস্তা দিয়ে নিত্য যাওয়া-আসা, অথচ এক বারও ভিতরে যাওয়া হয়নি। এমন মানুষের সংখ্যা এ শহরে কম নয়। এ বার বরং বড়দিনের ছুটিতে এক এক করে গির্জাগুলিতে ঢুঁ মারতে পারেন। শুধু শহর কলকাতা নয়, শহরতলির গির্জা দেখার জন্যও বেরিয়ে পড়তে পারেন শীতের মরসুমে।
আর্মেনিয়ান চার্চ
কলকাতার আর্মেনীয় গির্জার উল্লেখ পাওয়া যায় রবি ঠাকুরের সহজ পাঠে। ছবি: সংগৃহীত।
সুদৃশ্য বাগানে ঘেরা সাদা গির্জাটির বয়স ৩০০ বছর। কলকাতার পুরনো গির্জাগুলির তালিকায় নাম আসে আর্মেনিয়ান চার্চের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠেও নাম পাওয়া যায় এর। সেখানে লেখা, ‘‘আর্মানি গির্জের কাছে আপিস। যাওয়া মুশকিল হবে। পূর্ব দিকের মেঘ ইস্পাতের মতো কালো’’। সেই পুরনো গির্জায় কদাচিৎ উৎসাহী পর্যটকেরা গিয়ে পড়েন। শোনা যায়, প্রথমে গির্জাটি ছিল কাঠের। পরবর্তী কালে ১৭২৪ নাগাদ এক আর্মানি ব্যবসায়ীর উদ্যোগে পারস্যের এক স্থপতি পাকা গির্জাভবনটি নির্মাণ করেন। আরও পরে, ১৭৩৪ সালে আরও এক ব্যবসায়ী গির্জার চূড়াটি তৈরি করিয়ে দেন।
সেন্ট পল্’স ক্যাথিড্রাল
বিড়লা তারামণ্ডলের খুব কাছেই রয়েছে এই চার্চটি। ছবি: সংগৃহীত।
বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন হলেও কলকাতার সবচেয়ে বড় গির্জা বলে পরিচিত এটি। কলকাতা তারামণ্ডলের পাশেই সবুজ মাঠে ঘেরা সেন্ট পল্’স ক্যাথিড্রালে অবশ্য বছরভর পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। ইন্দো-গথিক স্থাপত্যের নিদর্শন এই গির্জাটি তৈরি করতে সময় লাগে আট বছর। ১৮৪৭ সালে তা সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
সেন্ট জন্’স চার্চ
ঘুরে নিতে পারেন সেন্ট জন্’স চার্চ। ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতার সঙ্গে জোব চার্নকের নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সেন্ট জন্’স চার্চের পাশেই রয়েছে জোব চার্নকের সমাধি। রাজভবনের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে প্রাচীন এই গির্জা। এর চত্বরে অসংখ্য স্মৃতিসৌধ রয়েছে। এর একটি বৈশিষ্ট্য হল গির্জার মেঝে, যা গাঢ় নীল-কালো পাথর দিয়ে তৈরি। জনশ্রুতি, প্রাচীন গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে মার্বেল পাথর নিয়ে আসা হয়েছিল গির্জায় ব্যবহারের জন্য। গ্রিক স্থাপত্যরীতিতে লন্ডনের সেন্ট স্টিফেন চার্চের আদলে তৈরি এই গির্জাটি ১৭৮৭ সালে উদ্বোধন করা হয়। নামকরণ হয় সেন্ট জন্’স চার্চ। পাথরের তৈরি বলেই লোকমুখে এর নাম পাথুরে চার্চ।
সেন্ট ওলাভ্’স চার্চ
শ্রীরামপুরের সেন্ট ওলাভ্’স চার্চ। ছবি: সংগৃহীত।
একদা ‘বিপজ্জনক’ ঘোষিত হওয়া শ্রীরামপুরের সেন্ট ওলাভ্’স গির্জা বছর আটেক আগে সেজে উঠেছিল নতুন ভাবে। এই বছর সেই গির্জাকে কেন্দ্র করে বড়দিনের বিশেষ উৎসবের সূচনা হল। পার্ক স্ট্রিটের মতোই আলোর সাজে সেজে উঠেছে কলকাতা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে হুগলি জেলার ভাগীরথীর পারের পুরনো শহর শ্রীরামপুর। আঠারো শতকের বেশির ভাগ সময়ে শ্রীরামপুরে ছিল ডেনমার্কের উপনিবেশ। জানা যায়, গভর্নর ওলি বি’র সময়ে প্রোটেস্ট্যান্ট নাগরিকদের জন্য ১৮০০ সাল নাগাদ এই গির্জার কাজ শুরু হয়। ভিতরে রয়েছে একটি সভাঘর, বেদি। পরবর্তী কালে শ্রীরামপুর কলেজ কর্তৃপক্ষ গির্জাটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পান। আস্তে আস্তে গির্জাটি জীর্ণ হতে শুরু করে। নষ্ট হয়ে যায় ছাদের কড়িকাঠ, জানলা-দরজা, আসবাব। ২০১১ সালে গির্জাটিকে ‘বিপজ্জনক’ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয় শ্রীরামপুর কলেজ। ২০১৩ সালে এই গির্জা সংস্কারের কাজ শুরু হয়। ২০১৬-তে আবার উদ্বোধন হয় চার্চটির।
ব্যান্ডেল চার্চ
ব্যান্ডেলেও রয়েছে বহু পুরনো চার্চ। ছবি: সংগৃহীত।
এক সময়ে হুগলি জেলার ব্যান্ডেল ছিল পর্তুগিজদের উপনিবেশ। এখানে বসবাসকালীন পাদরিদের সাহচর্যে এসে অনেকেই খিস্ট্র ধর্ম গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তাঁদের প্রার্থনাকক্ষের প্রয়োজন হয়। তারই ফলশ্রুতি হিসাবে তৈরি হয় ব্যান্ডেল চার্চ। ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজেরা গঙ্গার পারে চার্চ নির্মাণ করেন। ১৬৩২ সালে ইসলামিক আক্রমণে চার্চটি ধ্বংস হয়। নতুন চার্চটি তৈরি হয় ১৬৬০ সালে। প্রতি বছর বড়দিনে উৎসব হয় ব্যান্ডেল চার্চে।
তবে গির্জা দেখতে ২৫ ডিসেম্বর বা ৩১ ডিসেম্বরের মতো দিনগুলিতে কোনও কোনও চার্চে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। অতিরিক্ত ভিড়ের আশঙ্কায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমন দিনে গেলে বাইরে থেকে চার্চ দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।