Mamata Banerjee

মমতার ১০৮ মিনিট! কারা হারলেন, কারা জিতলেন, নবান্ন ম্যাচের খতিয়ান নিল আনন্দবাজার অনলাইন

শিক্ষা, পরিবহণ এবং আলুর রফতানি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে রাজ্যের চার জন মন্ত্রীকে। অন্য দিকে, একাধিক মন্ত্রীর একাধিক প্রস্তাব গ্রহণও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:৩০
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবিতে কোচ শাহরুখ খানের সংলাপ জনমনে এখনও অমর হয়ে আছে, ‘‘সত্তর মিনিট! সির্ফ সত্তর মিনিট হ্যায় তুমহারে পাস!’’ সেলুলয়েডের কাহিনিতে সেই ৭০ মিনিটের হকি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে মহিলাদের বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। বৃহস্পতিবার দুপুরে নবান্ন সভাঘরে ১০৮ মিনিটের একটি ‘ম্যাচ’ হল। যেখানে তাদের কাজের খতিয়ান দেওয়া-নেওয়া হল গ্যালারির সামনে। বাস্তবের সেই হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচে যুযুধান দু’পক্ষ অবশ্য একে অপরের সতীর্থ। দু’পক্ষের কোচও একজনই— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন থেকেই ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের জন্য প্রশাসনিক প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন মমতা। রাজ্যের সমস্ত জেলা, মহকুমা, ব্লক স্তরের প্রশাসনিক আধিকারিক, পুলিশকে নিয়ে বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রীও। ১০৮ মিনিটের সেই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর ধমক শুনতে হল চার মন্ত্রীকে। আবার বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসাও পেলেন কয়েক জন মন্ত্রী।

বকুনি খাওয়ার তালিকায় ছিলেন কৃষিমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার, কৃষি বিপণনমন্ত্রী বেচারাম মান্না, পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী এবং শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। মুখ্যমন্ত্রীর রোষানলে পড়তে হল একাধিক আমলা, এবং পুলিশকর্তাকেও। যে সমস্ত মন্ত্রীর দেওয়া বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ করে ‘বার্তা’ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা, তাঁদের তালিকা ছোট নয়। সেই তালিকায় ছিলেন ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন, স্বপন দেবনাথ প্রমুখ। বাবুল সুপ্রিয়, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যেরা মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নে ‘সন্তোষজনক’ উত্তর দিয়েছেন। অন্তত মুখ্যমন্ত্রীর অভিব্যক্তি দেখে তেমনই মনে হয়েছে।

Advertisement

কেন ধমক

বৈঠকের শুরুর আধঘণ্টার মধ্যেই আলুর সঙ্কট নিয়ে প্রদীপ এবং বেচারামকে মুখ্যমন্ত্রীর ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়। প্রদীপের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘প্রদীপদা, আপনি আর বেচা মিলে তো আলু ছেড়ে দিলেন!’’ প্রদীপ বলেন, ‘‘একটা অন্যায় হচ্ছিল। সেটা নজরে আসার পরেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’ কিন্তু সেই জবাবে সন্তুষ্ট হননি মুখ্যমন্ত্রী। তিনি পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘কেন আগে নজরে আসেনি? মানুষ মরে গেলে তার পর ডাক্তার ডেকে কী লাভ?’’

যদিও পরে আলু নিয়ে ‘দুষ্টুচক্রের’ সন্ধান দেন বেচা। সিঙ্গুরের বিধায়ক বলেন, ‘‘ক্রিকেটে যেমন বেটিং চলে, তেমন আলুতেও একটা সিস্টেম আছে। এটাকে ভোটিং মার্কেট বলে। কলকাতার দিকে যে আলু আসে, মূলত সেই মার্কেটে এরা এই কালোবাজারি করে। বর্ধমানের মেমারি, কালনার বুলবুলি তলা, হুগলির বৈঁচি, ভান্ডারিহাটি, তারকেশ্বর এলাকা থেকে এটা করা হয়। এরা মনোপলি রেট ঠিক করে। আগামী কাল আলুর রেট কী হবে, তারা আজ সন্ধেয় বসে ঠিক করে।’’ বেচার কথা শুনে সেই ‘চক্র’ ভাঙার নির্দেশ দেন মমতা। বেচারাম জানান, তিনি মুখ্যসচিবকে রিপোর্ট দিয়েছেন।

পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিসকেও মুখ্যমন্ত্রীর ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। পরিবহণ দফতরকে ‘সাইলেন্স’ দফতর বলেও কটাক্ষ করেন মমতা। মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, ‘‘অফিস ছুটির পরে কোথায় কত লোক দাঁড়িয়ে থাকেন, কোথায় বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, এ ব্যাপারে কোনও সমীক্ষা হয়েছে কি? পরিবহণমন্ত্রী কি হঠাৎ কোথাও পরিদর্শনে গিয়েছেন?’’ স্নেহাশিস বলেন, ‘‘দিদি, কিছু সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।’’ শুনে ফের ক্ষুব্ধ মমতা বলেন, ‘‘কিছু? কিছু কথাটার মানে কী? তুমি একটা ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার! ‘কিছু’ কথাটা বলা যায় না।’’ তার পরে নির্দেশ দেন, মন্ত্রীকে আইটি সেক্টর-সহ গোটা কলকাতা ঘুরে দেখতে হবে, কোথায় কী পরিস্থিতি। ভিজ়িটিং আওয়ারের পরে হাসপাতালগুলির সামনে কী অবস্থা হয়, তা-ও দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ পরীক্ষা ব্যবস্থায় যে বদলের কথা ঘোষণা করেছিল, সেই সিমেস্টার নিয়ে ব্রাত্যকে শুনতে হয়েছে মমতার ভর্ৎসনা। মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, প্রাথমিকে কোনও সিমেস্টার পদ্ধতি চালু হবে না। জানতে চান, কী ভাবে ওই ঘোষণা হল? কেন মুখ্যমন্ত্রী বা মুখ্যসচিবকে বিষয়টি আগাম জানায়নি শিক্ষা দফতর? ব্রাত্যকে সর্বসমক্ষেই ভর্ৎসনা করেন মমতা। বিড়ম্বিত শিক্ষামন্ত্রী প্রথমে বলেন, ‘‘মুখ্যসচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। আপনি অনুমোদন না দিলে বিজ্ঞপ্তি জারি হবে না।’’ শুনে আরও ক্ষুব্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘অনুমোদন হয়নি তো কাগজে বেরোল কী করে? যা মেসেজ (বার্তা) যাওয়ার তো চলে গেল!’’ বাক্যব্যয় না করে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়ে দেন, প্রাথমিকে সিমেস্টার পদ্ধতি চালু হবে না।

কেন প্রশংসা

মমতা নির্দেশ দেন, সব দফতরের জন্য পৃথক পৃথক অ্যাপ তৈরি করতে হবে। প্রকল্পকেন্দ্রিক সমীক্ষা যাতে সঠিক ভাবে হয়, তা-ও নিশ্চিত করার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। এর পরেই পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ প্রস্তাব দেন, যে অ্যাপ তৈরি হবে, তাতে সমীক্ষা রিপোর্ট আপলোডের বন্দোবস্ত করা হোক। তাতে কোন আধিকারিক সমীক্ষা করছেন, তার ‘রেকর্ড’ থাকবে। কোনও ত্রুটি হলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিককে চিহ্নিত করা যাবে। ফিরহাদের প্রস্তাব কার্যকর করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘ববির প্রস্তাবটা ভাল!’’

সরকারি জমি ‘জবরদখল’ রুখতে প্রশাসনকে একগুচ্ছ নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের ভূমিকারও কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি। বৈঠকের মধ্যে যখন ভূমিরাজস্ব দফতরের কাজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখনই মন্ত্রী স্বপন বলেন, ‘‘বার বার বলার পরেও সরকারি খাল, বিল, নয়ানজুলিতে বিএলআরও-রা বোর্ড লাগাচ্ছেন না। এটা করতে পারলে সরকারের অনেক রাজস্ব আসবে।’’ স্বপনের বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই তাঁর প্রস্তাব কার্যকর করতে পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসককে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী।

কিছুটা প্রসঙ্গান্তরে গিয়েই উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন দিনহাটায় দিল্লি পুলিশের তল্লাশির বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে অবগত করেন। বলেন, তাঁর কেন্দ্র দিনহাটায় দিল্লি পুলিশ এসে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে ‘তথ্য’ যাচাই করছে। অমিত শাহের পুলিশের সেই অভিযান সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ কিছু জানে না বলে অভিযোগ করেন উদয়ন। পাশাপাশি বলেন, ওই ঘটনাকে ‘হাতিয়ার’ করে একটি রাজনৈতিক দল (বিজেপি) ভয় দেখাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। উদয়নের কথা শুনে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ বা রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার ওই বিষয়ে কিছু জানেন কি না। তাঁরা জানান, তাঁদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই। কিন্তু জেলা প্রশাসন জানায়, তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। তার পর জেলা প্রশাসনকে কার্যত তুলোধনা করেন মমতা। বাইরের রাজ্যের পুলিশ রাজ্যে এলে কী ভাবে কাজ করার নিয়ম, সে ব্যাপারেও পাঠ দেন মমতা।

মন্ত্রী অরূপ বলেন, ‘‘যে সংস্থা যে কাজের টেন্ডার (দরপত্র) পাচ্ছে, তারা সময়ে কাজ শেষ করছে না। এক বছর বলে তিন বছর কাটিয়ে দিচ্ছে! এ জন্য দরকার জরিমানা চালু করা।’’ অরূপের প্রস্তাব শুনে প্রথমে অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমাকে সেই দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সংযোজন করেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট দফতর এই বিষয়টা করলে কাজের সুবিধা হবে। তার পরে অর্থ দফতর অনুমোদন দিক।’’ মৌখিক ভাবে তাতেই সিলমোহর দেন মুখ্যমন্ত্রী। তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বাবুল, স্বাস্থ্য ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমাকে মুখ্যমন্ত্রী যা যা প্রশ্ন করেন, তার ‘সন্তোষজনক’ জবাব দিয়েছেন তাঁরা। যদিও স্বাস্থ্যের একাধিক বিষয় কার্যকর না-করার জন্য স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে মুখ্যমন্ত্রীর মৃদু ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। বস্তুত, নিগমকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এখনও কেন ৩ শতাংশ রেফারেল হচ্ছে? স্বাস্থ্যসাথীর বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?’’

মুখ্যমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট, নবান্ন চাইছে প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘দীর্ঘসূত্রিতা’ কাটাতে। যে কারণে একাধিক পরিকাঠামোগত পদক্ষেপও করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথম থেকেই যে তিনি প্রশাসনের সর্ব স্তরে ‘ঝাঁকুনি’ দিতে শুরু করবেন, ঘনিষ্ঠমহলে তা আগেই জানিয়েছিলেন মমতা। রাজ্য প্রশাসনের এক উচ্চ স্তরের আধিকারিক তখনই বলেছিলেন, ‘‘উনি ঝাঁসির রানির মতো তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নামবেন।’’ বৃহস্পতিবারের প্রশাসনিক বৈঠক অন্য ছবি দেখায়নি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement