মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
ঝাঁকুনি দেওয়া শুরু করেছিলেন মাস দেড়েক আগে। সিআইডির ‘খোলনলচে’ বদলে দেওয়ার হুঁশিয়ারি-সহ। সেই ঘোষণা অনুযায়ীই নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বড়সড় রদবদল ঘটিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের একাধিক শীর্ষপদে। সেই ‘ভূমিকম্প’ মিটতে না মিটতেই পুলিশবাহিনীর উপর ‘আফটার শক’ নেমে এল বৃহস্পতিবার নবান্নের প্রশাসনিক বৈঠকে। যেখানে অন্তত পাঁচটি বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়ল রাজ্যের পুলিশবাহিনী।
তার সঙ্গেই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে মমতা বলেছেন, তিনি পুলিশে কোনও ‘লবি’ বরদাস্ত করবেন না। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘পুলিশে লবি বন্ধ করতে হবে। কোনও লবি চলবে না। যে কাজের লোক, তাকে নিতে হবে। অনেক সৎ পুলিশ অফিসার আছে, যারা খেটে খায়। তাদের দিকে নজর দিতে হবে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট, তাঁর লক্ষ্য পুলিশবাহিনীর অন্দরে ‘লবি’। প্রশ্ন সেখানেই। শাসকদল এবং প্রশাসনের অন্দরে দীর্ঘ দিন এই জল্পনা চলে আসছে যে, দলের তরফে পুলিশের ‘দায়িত্ব’ পালন করে থাকেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আগে যে ‘ভার’ ছিল মুকুল রায়ের উপর। তবে এই পদ্ধতি এই রাজ্যে তৃণমূল আমলে নতুন নয়। বাম আমলেও দলের তরফে পুলিশ ‘দেখাশোনা’ করার ভার থাকত সিপিএমের প্রথম সারির কোনও না কোনও নেতার উপর। পোশাকি ভাবে যাকে বলা হত ‘সমন্বয়’। তবে এ সব বরাবরই ‘জল্পনা’ হয়ে থেকে গিয়েছে। ‘খবর’ নয়। কারণ, এর কোনও সমর্থন কোনও স্তরেই কখনও মেলেনি। মেলে না। ভবিষ্যতেও মিলবে না। তবু মমতার বৃহস্পতিবারের বিভিন্ন মন্তব্য ‘ইঙ্গিতবাহী’। সেগুলি একটি ধারাবাহিক পদ্ধতির অংশও বটে, যা তিনি শুরু করেছিলেন সিআইডির আগাপাশতলা বদল করার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে। ঘটনাচক্রে, মমতার তোপের মুখে তাঁর ‘আস্থাভাজন’ হিসেবে পরিচিত রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার পড়েননি। মুখ্যমন্ত্রী রুষ্ট মনোভাব ব্যক্ত করেছেন বেশ কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার সম্পর্কে, যা থেকে অনেকে এই উপসংহারে পৌঁছচ্ছেন যে, ক্ষমতার ‘ভরকেন্দ্র’ চিনতে ভুল করলে সমস্যা হবে। ‘লবিবাজি’ যাঁরা করছেন, তাঁদের দুর্দিন সমাগত।
প্রশাসনিক বৈঠকে পুলিশকে তোপ দাগা মমতা শুরু করেছিলেন একেবারে প্রথম থেকেই। তার পরে ঘন্টাদুয়েকের বৈঠকে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে পুলিশের একটি অংশ সম্পর্কে তাঁর উষ্মা। মমতার কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছে একের পর এক জেলার পুলিশ সুপারকে। আইবি-র ‘অপদার্থতা’ নিয়েও তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী।
১. জমি জবরদখল
বৈঠকের শুরুর দিকেই সরকারি জমি জবরদখল মুক্ত করার বিষয়ে কড়া বার্তা দিচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি সম্পত্তি বেহাত হওয়ার ক্ষেত্রে যে সব সরকারি আধিকারিকের মদত থাকবে, তাঁরাও ছাড় পাবেন না বলে হুঁশিয়ারি দেন মমতা। ঠিক তখনই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম আলগোছে তুলে ধরেন ওই বিষয়ে পুলিশের ভূমিকার বিষয়টি। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে আর্জি রাখার ভঙ্গিতে ফিরহাদ বলেন, জবরদখলমুক্ত জমিতে আবার নতুন করে কেউ যাতে বসতে না পারে, সেটা পুলিশ নিশ্চিত করলে ভাল হয়। দ্রুত মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘পুলিশকে বার বার বললেও পুলিশ এগুলো দেখে না!’’ পাশাপাশিই বললেন, নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া কিছু নিয়মকে ‘হাতিয়ার’ করে পুলিশ ইদানীং দায়সারা ভাবে কাজ করছে। উষ্মা প্রকাশ করলেন এই বলেও যে, একজন পুলিশ আধিকারিক নিজের মেয়াদ শেষে অন্যত্র বদলি হওয়ার আগে কেন এলাকার হালহকিকত উত্তরসূরিকে বুঝিয়ে দিয়ে যান না!
২. মালদহে খুন
বৃহস্পতিবার সকালেই মালদহে খুন হয়েছেন তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি তথা ইংরেজবাজার পুরসভার দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর দুলালচন্দ্র সরকার (বাবলা)। সেই খুনের প্রসঙ্গে সরাসরি মালদহের পুলিশ সুপারকে কাঠগড়ায় তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের জন্য মালদহে আমাদের একজন খুন হয়ে গেল। অবশ্যই পুলিশের গাফিলতিতে খুন হয়েছে। ওর উপর আগেও আক্রমণ করা হয়েছিল। আগে নিরাপত্তা পেত। পরে সেটা তুলে নেওয়া হয়। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। আমি ওকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম। এসপি-কে বলব, এগুলো দেখুন। শুধু কালিয়াচক আর বর্ডার নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না।’’
৩. অশুভ আঁতাঁত
এর পরেই বিএসএফের সঙ্গে মালদহ জেলা পুলিশের ‘অশুভ আঁতাঁতের’ কথা তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘পুলিশ ওখানে বিএসএফের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ঢোকাচ্ছে।’’ তবে পরের বাক্যে নিজেকে ঈষৎ শুধরে নিয়ে মমতা বলেন, ‘‘অনুপ্রবেশকারী ঢোকাচ্ছে বিএসএফ। পুলিশ কিছু বলছে না। সমঝোতা করে চলছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজীব কুমারের কাছে বেশ কিছু তথ্য এসেছে। ইসলামপুর, চোপড়া, সিতাই দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের ঢোকানো হচ্ছে। বাংলাকে বদনাম করার জন্য বিএসএফ-কে দিয়ে কেন্দ্র এ সব করাচ্ছে বলেও তোপ দাগেন মমতা। সে প্রসঙ্গেই পুলিশকে আবার কাঠগড়ায় তুলে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ এ সব আটকাচ্ছে না। বিএসএফের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছে।’’
৪. দিনহাটাকাণ্ড
কোচবিহারের দিনহাটার বিধায়ক তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ বৈঠকে বলেন, দিল্লি পুলিশ তাঁর জেলায় এসে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়েছে। শুনে দৃশ্যতই ক্রুদ্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশ সুপারের উদ্দেশে বলেন, দিল্লি পুলিশ কেন এল? তারা কি রাজ্য পুলিশের অনুমতি নিয়েছিল? অনুমতি ছাড়া ভিন্ রাজ্যের পুলিশ অবাধে এসে এ রাজ্যে যা খুশি তাই করছে কী করে? রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে কেন বিষয়টি জানাননি এসপি? ঘটনাচক্রে, একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেননি পুলিশ সুপার। এর পরই ডিজি-কে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশ সুপারকে বলেন, ‘‘এ ভাবে কাজ করলে এসপি হওয়া যায় না।’’
৫. বালি-মাটি-পাথর
বেআইনি বালি খাদান, মাটি পাচার এবং পাথর পাচার নিয়েও মুখ্যমন্ত্রীর নিশানায় থেকেছে পুলিশ। বীরভূম জেলার নাম আলাদা করে উল্লেখ করেছেন তিনি। সেই জেলায় ‘অবৈধ কার্যকলাপ’ তৃণমূলের কথায় নয়, বিজেপির কথায় হচ্ছে, টাকা বিজেপির ফান্ডে ঢুকছে— এমন মন্তব্যও শোনা গিয়েছে মমতার মুখে। তিনি বলেছেন, দুবরাজপুর, মহম্মদবাজার বা সিউড়ির আইসি-রা কী করছেন, সে সব খবরই তাঁর কাছে রয়েছে।
রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাশাখা আইবি-র কাজ নিয়ে চূড়ান্ত অসন্তোষ দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কথায়। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আইবি-র কাছে একটাও ইনফরমেশন (তথ্য) থাকে না। নিজেদের পোস্টটাকে নিয়ে তাঁরা খেলা করছেন।’’ ডিজি-কে তিনি নির্দেশ দেন, ‘‘আইবি-র দিকে নজর দাও, রাজীব।’’ আর বারংবারই মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘পুলিশে কোনও লবি চলবে না। মনে রাখবেন, লবি একটাই— মানুষের লবি।’’