(ডান দিকে) নরেন্দ্র মোদী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁ দিকে)। — ফাইল চিত্র।
বাংলার পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে শনিবার সকালে তৃণমূলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অডিয়োবার্তা প্রকাশ্যে এসেছে। সেখানে বিজেপি-আমলের ‘দুর্নীতি’ নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছে মমতাকে। সময় প্রবাহ বলছে, মোদীর বক্তব্যের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে মমতার অডিয়োবার্তা। যা দেখে মনে করা হচ্ছে, মোদীর শনিবারের বক্তব্যেরই পাল্টা আক্রমণ করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। যদিও তৃণমূলের একাংশ মনে করছেন, সংসদে অনাস্থা-বিতর্কের সময় মোদীর ভাষণের পাল্টা হিসাবে ওই অডিয়োবার্তা রেকর্ড করে রাখা ছিল। শনিবার সেটাই প্রকাশ্যে আনা হয়েছে। অন্য একটা অংশের মত, এটা মোদীর শনিবারের বক্তব্যেরই পাল্টা।
শনিবার বিজেপির পূর্বাঞ্চলীয় পঞ্চায়েতিরাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ রাজ্যেরই পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটে ওই সম্মেলন হচ্ছে। সেখানে হাজির হয়েছেন বিজেপি সভাপতি জেপি নড্ডা। সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় মোদী বাংলার পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তোলেন।
তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মমতার একটি অডিয়োবার্তা প্রকাশ্যে আসে। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘টিম ইন্ডিয়া প্রসঙ্গে তিনি প্রমাণ ছাড়া যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন। তিনি চাইছেন গরিব মানুষ মারা যাক। দেশের মৃত্যু হোক। সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে থাকুক। শুধুমাত্র বিজেপি থাকবে। তিনি তাঁর মতাদর্শ দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছেন না।’’ এর পরেই মোদী জমানায় ‘দুর্নীতি’র কথা উল্লেখ করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আপনি কখনওই দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেন না। কারণ, আপনি নিজেই অনেক বিষয়ে ঘিরে রয়েছেন। যেমন, পিএম কেয়ার ফান্ড, রাফাল চুক্তি, দেশের প্রতিরক্ষা কারখানা বিক্রি করে দিচ্ছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে দিচ্ছেন।’’ মমতা বলেছেন, ‘‘নোট বাতিল করা হয়েছে নোটবন্দির নামে। আপনি নিজের এবং নিজের পার্টির স্বার্থে ২ হাজার টাকার নোট বাতিল করেছেন। আপনি সব সময় মানুষকে বোকা ভাববেন না। কিছু সময় মানুষকে বোকা বানানো যায়, কিন্তু সব সময় আপনি মানুষকে বোকা বানাতে পারবেন না।’’
প্রধানমন্ত্রী ‘নিজেদের দুর্নীতিপরায়ণ লোকদের’ বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেন না বলেও ওই অডিয়োবার্তায় আক্রমণ করেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও (চ্যারিটি বিগিংস অ্যাট হোম)। আপনি আগে নিজের চেহারা দেখুন। আপনি নিজেদের দুর্নীতিপরায়ণ লোকেদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেন না। যাঁরা চরিত্রহননের কাজ করে, মহিলাদের অসম্মান করে, যারা কুস্তিগিরদের বিরুদ্ধে অন্যায় করে, যারা মণিপুরে অন্যায় করে, সব জায়গায় যারা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে… আপনাদের লোকেরা বাংলার ১৬-১৭ জন মানুষকে হত্যা করেছেন। তাঁদেরকেও আপনি রাজনৈতিক বাতাস দিয়ে চলেছেন।’’
শনিবার নিজের বক্তব্যে তৃণমূলকে আক্রমণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এই ভোটে তৃণমূল কেমন রক্তের খেলা খেলেছে, এটা সারা দেশ দেখেছে। এদের ভোটপদ্ধতি কেমন ছিল? প্রথমে ভোটে লড়ার প্রস্তুতির সময়ই দিয়ো না। দ্বিতীয়ত, ভোটে মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য কম সময় দাও। তাই তাড়াতাড়ি ফর্ম ভরার সময় ঘোষণা করে দাও! তার পর কোনও বিজেপি অথবা বিরোধীদের কেউ যাতে মনোনয়নের ফর্ম ভরতে না পারে, তার জন্য যা করার হয় করো। তার পরেও যদি কেউ বিভিন্ন উপায়ে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য পৌঁছেও যান, তাঁকে ভোটে লড়তে বাধা দাও।’’
প্রধানমন্ত্রী আরও অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘শুধু যে বিজেপি কর্মকর্তাদের ধমকেছে এমন নয়, ভোটারদেরও ভয় দেখিয়েছে। বিজেপি কর্মীদের যে সমর্থক এবং তাঁদের আত্মীয় আছেন, তাঁদেরও বাঁচা মুশকিল করে দেওয়া হয়েছে। আর তার পর ভোটের সময় ছাপ্পা দেওয়া হয়েছে। তখন তোলাবাজদের ফৌজ ছাপ্পাবাজের ফৌজ হয়ে যায়। সব গুন্ডাদের ভাড়া করা হয়, কী ভাবে এবং কোন কোন বুথ কে দখল করবেন তা ঠিক করে ফেলা হয়। তার পর ভোটের মেশিন নিয়ে পালানো... এবং এখানেই শেষ নয়। ভোটগণনার সময়েও বিজেপির কার্যকর্তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া, তাঁদের গণনাকেন্দ্রের কাছে থাকতে না দেওয়া— এত জুলুমের পরেও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ বিজেপিকে আশীর্বাদ করেছেন।’’
বাংলায় বিজেপি হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা৷ তাই প্রধানমন্ত্রীকে হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘আপনাদের কাজ বাংলায় মণিপুরের মতো জাতিদাঙ্গা লাগানো। আপনাদের কাজ দার্জিলিংকে টুকরো করা। এ আগুন আমরা জ্বালাতে দেব না। প্রয়োজন হলে আমার মৃতদেহের ওপর আমাকে আগুন জ্বালাতে হবে। তবে নোংরা হিংসার খেলা করতে দেওয়া যাবে না।’’
রাজ্যপাল পদ রাখা নিয়ে ফের আপত্তি তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলার বর্তমান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধেও তোপ দেগেছেন তিনি। মমতার অভিযোগ, রাজভবনকে দিয়ে সমান্তরাল শাসন চালানো হচ্ছে । রাজ্যপাল পদ রাখা নিয়ে ফের আপত্তি তুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। পাশাপাশি বাংলার বর্তমান রাজ্যপাল বোসের বিরুদ্ধেও তোপ দেগেছেন তিনি । কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, রাজভবনকে দিয়ে সমান্তরাল শাসন চালানো হচ্ছে ।
তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, “নরেন্দ্র মোদী দামোদর দাস মোদী আপনি হলেন প্রতারক। এক আধটা কারণ নয়। অন্তত ৭টি কারণে আপনাকে প্রতারক বলা যায়”। করোনা সংক্রমণের সময় যে পিএম কেয়ার্স ফান্ড তৈরি হয়েছিল, তা নিয়েও বড়সড় প্রশ্ন চিহ্ন তুলে দিয়েছেন তিনি। ডেরেকর কটাক্ষ, ‘‘এটা আসলে ‘পিএম ডাস নট কেয়ার ফান্ড’। ওই ফান্ডে কারা টাকা দিয়েছিল? তালিকা দিন কোন কোন চিনা কোম্পানি টাকা দিয়েছিল পিএম কেয়ারে। টিকটক, ওয়ান প্লাস, হুয়াউই, শাওমি কারা সেই সব কোম্পানি।’’
প্রধানমন্ত্রীর এ হেন আক্রমণের পর তৃণমূলের তরফে তার জবাব দিয়েছেন জাতীয় মুখপাত্র তথা রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজাও। শ্যামপুকুরের বিধায়ক শশী বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বিজেপির অনুষ্ঠানে হাজির থাকার সময় পান। কিন্তু মণিপুরে যাওয়ার সময় পান না। আপনি ভাষণ দিয়ে বেশ কিছু অসত্য কথা বলেছেন। বাংলার প্রতি আপনাদের এমন ব্যবহারের কারণ, আপনারা বিধানসভা নির্বাচনে জিততে পারেননি। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও আপনারা জিততে পারেননি। তাই বলে আপনি বাংলা প্রসঙ্গে অসত্য কথা বলবেন?’’
শশী আরও বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখানে আদিবাসী ও দলিতদের উপর অত্যাচার করে রাজ্য সরকার। সবাই জানে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশে দলিত ও আদিবাসীদের সঙ্গে কী ব্যবহার করে বিজেপি এবং বিজেপিশাসিত সরকার। তাঁদের গায়ে প্রস্রাব করে দেওয়া হচ্ছে, মহিলাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে।’’