প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দিল্লিতে তৃণমূলের কর্মসূচি ‘সফল’ হওয়ার পিছনে দলীয় নেতৃত্বকেই দায়ী করছে বিজেপির একাংশ। প্রশ্ন ঘুরছে মুখে মুখে— তৃণমূলের কর্মসূচিকে পদে পদে বাধা দিয়ে, একের পর এক প্রতিক্রিয়া দিয়ে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কি কোনও দরকার ছিল?
দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই দিল্লিতে তাদের কর্মসূচি পালন করেছে তৃণমূল। ‘সফল’ কর্মসূচির পাশাপাশিই অভিষেক ‘বিরোধী নেতা’র ভূমিকাও সফল ভাবে পালন করেছেন। রাজ্য স্তরের এক বিজেপি নেতা তো রাগের মাথায় বুধবার বলেই ফেললেন, ‘‘অভিষেককে নেতা বানানো হচ্ছে!’’
অভিষেকের এই ‘সাফল্যে’র জন্য নিজেদের দলের দিকেই আঙুল তুলছেন বিজেপির কর্মী থেকে নেতাদের একটা বড় অংশ। জেলা স্তরের নেতাদের আঙুল রাজ্য নেতৃত্বের দিকে। আর রাজ্যের নিশানায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সোম আর মঙ্গলবারের ঘটনাক্রমকে ঘিরে মোটামুটি পাঁচটি প্রধান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নেতাদের।
১। তৃণমূল কর্মীদের ট্রেন না-দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? একটি ট্রেনে খুব বেশি হলে হাজার দেড়েক কর্মী যেতে পারতেন। বিমানে, ট্রেনে, বাসে অনেকে চলেও গিয়েছেন। মাঝখান থেকে বিষয়টা নিয়ে তৃণমূলকে প্রচারের সুযোগ দেওয়া হল কেন?
২। দিল্লিতে সোমবার তৃণমূলের প্রথম দিনের কর্মসূচিতে তেমন কিছুই ছিল না। মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেওয়ার পাশাপাশি মৌনী অবস্থানের পর সাংবাদিক বৈঠক করেন অভিষেক। সেখানে পুলিশ পাঠিয়ে বাধা দিয়ে কেন বিষয়টিকে বেশি করে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা হল?
৩। সোমবারই দিল্লিতে তড়িঘড়ি পৌঁছে যান রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তিনি দুই সাংসদকে পাশে বসিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন। এর পরেও অভিষেকের তোলা কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগের জবাব দিতে তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ, অনুরাগ ঠাকুর এবং সুভাষ সরকার সাংবাদিক বৈঠক করেন। এক জনের জবাব দিতে এত বড় বাহিনীর প্রয়োজন ছিল কি?
৪। মঙ্গলবার দুপুরে শুভেন্দু অধিকারী দিল্লিতে গিয়ে প্রথমে সাংবাদিক বৈঠক করেন। তার পরে গ্রামোন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী নিরঞ্জন জ্যোতির সঙ্গে বৈঠক করেন। কেন্দ্রের অভিযোগ, রাজ্য হিসাব না দেওয়াতেই প্রাপ্য আটকে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে রাজনীতি মেশানোর প্রয়োজন ছিল কি?
৫। সন্ধ্যায় সময় দিয়েও কেন মন্ত্রী তৃণমূলের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করলেন না! স্মারকলিপি নিয়ে নিলে কী এমন সমস্যা হত? তার পরিবর্তে তৃণমূল নেতাদের আটক করার প্রয়োজন ছিল কি? জোর করে প্রিজ়ন ভ্যানে তোলার ছবি কি তৃণমূলকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে দমনমূলক আচরণের অভিযোগ আনার ‘হাতিয়ার’ তৈরি করে দিল না?
তবে পাশাপাশিই রাজ্য বিজেপির অনেকের আবার দাবি, রাজ্যে যে ভাবে বিজেপিকে তাদের কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে পদে পদে বাধা দেওয়া হয়, সেটাই দিল্লিতে করা হয়েছে। ‘ইটের বদলে পাটকেল’ কাকে বলে তা তৃণমূলকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। যদিও এই যুক্তি কর্মীদের তোলা প্রশ্ন চাপা দিতে পারছে না।
প্রায় ১৪ মাস ধরে রাজ্যের বিজেপি কর্মীরা আশা-নিরাশার দোলাচলে। ২০২২ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই বিজেপি শিবিরে এমন একটা আবহ তৈরি হয় যে, রাজ্যে তৃণমূল সরকার আর বেশি দিন নয়। তার আগে থেকেই রাজ্য নেতৃত্ব, বিশেষত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু বলে আসছিলেন, সরকারের ‘সময়’ হয়ে এসেছে। কিন্তু সেই ‘সময়’ আসেনি। বস্তুত, কোনও ‘সময়’ই আসেনি। হতাশা বেড়েছে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। এখন সেই ‘হতাশা’ দেখা যাচ্ছে রাজ্য নেতাদের একাংশের মধ্যেও। প্রকাশ্যে না-বললেও ঘরোয়া আলোচনায় তাঁরা তা চেপে রাখছেন না।
গত এক বছরের মধ্যে আদালতের একের পর এক নির্দেশ বিজেপি নেতা-কর্মীদের ‘বড়’ কিছু ঘটার আশা বাড়িয়ে দিয়েছে। অনুব্রত মণ্ডল-সহ তৃণমূলের কয়েক জন নেতা এবং বিধায়কের গ্রেফতারিতে সেই আশা বেড়েছে। এমনকি, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ নিয়ে মামলার শুনানিতেও নবান্ন বিপাকে পড়বে ভেবে ‘বড়’ কিছু ঘটার আশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন যে ভাবে অভিষেকের ‘উত্থান’ হচ্ছে, তাতে কর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। শুধু তা-ই নয়, তৃণমূলের সঙ্গে ‘সেটিং’ হয়েছে কি না, তা নিয়েও কর্মীরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
দক্ষিণবঙ্গের এক জেলা সভাপতি সরাসরি তৃণমূলের কর্মসূচি নিয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘দিল্লিতে তৃণমূলের কর্মসূচি স্বাভাবিক ভাবে হতে দিলে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রথমেই স্মারকলিপি নিয়ে নিতে রাজি হয়ে গেলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ততটা প্রচার পেতেন না, যতটা এখন পাচ্ছেন। কলকাতা থেকে এই সময়ে রাজ্য সভাপতি এবং বিরোধী দলনেতার দিল্লিতে গিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করারই বা কী দরকার ছিল?’’ বার বার অভিষেককে ‘মঞ্চ’ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওই নেতার।
তবে প্রকাশ্যে রাজ্য বিজেপির কেউই এ নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বক্তব্য, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যেমন ভাল বুঝেছেন, তেমন ভাবেই এগিয়েছেন। শৃঙ্খলাবদ্ধ দলে তা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলা যায় না। তবে এরই পাশাপাশি এক নেতার আক্ষেপ, ‘‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি বাংলার বাস্তবটাও বুঝতে পারতেন!’’