সিকিমের মেঘভাঙা বৃষ্টিতে বিপদে পড়েছে বাংলা। সেই বিপদ কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশই বা কী? বিশদ জানাল নবান্ন।
নিম্নচাপের নাগাড়ে বৃষ্টিতে ইতিমধ্যেই জেরবার দুই বঙ্গ। এরই মধ্যে গত কয়েক দিন ধরে ধীরে ধীরে জল ছাড়তে শুরু করেছে ডিভিসি। ফলে দক্ষিণবঙ্গের পাঁচ-ছ’টি জেলায় এমনিতেই প্লাবনের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এর মধ্যেই সিকিমের হ্রদভাঙা জলে বন্যার আশঙ্কা ঘনাল উত্তরবঙ্গেও।
পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে পায়ে চোটের কারণে ঘরবন্দি মুখ্যমন্ত্রীকে বুধবার বাড়ি থেকেই বসতে হয়েছে নবান্নের জরুরি বৈঠকে। সেখানে রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুই বঙ্গ মিলিয়ে আপাতত ৯টি জেলায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন মমতা।
সিকিমের লোনক হ্রদ ফেটে জল হুড়মুড়িয়ে এসে মিশেছে তিস্তায়। সামাল দিতে তিস্তার উপরে চুংথাম বাঁধেরও জল ছাড়তে হয়েছে। নবান্ন জানিয়েছে, প্রতি সেকেন্ডে ৮০০০ কিউবিক মিটার জল ছাড়া হয়েছে তিস্তার ওই বাঁধ থেকে। যার জেরে বিপদ বাড়বে কালিম্পং, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলায়।
আচমকা জল বৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তার জলস্তর এক ধাক্কায় বেড়েছে ২০ ফুট। ফলে উত্তরবঙ্গের যে জেলাগুলির উপর দিয়ে তিস্তা বয়ে গিয়েছে, সেখানেই এই জলের প্রভাব পড়বে।
নবান্ন জানিয়েছে, উত্তরবঙ্গের ওই চারটি জেলায় ইতিমধ্যেই ২৮টি সরকারি আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছে। এর মধ্যে কালিম্পংয়ে ৬টি, দার্জিলিঙে ৩টি, জলপাইগুড়িতে ১১টি এবং কোচবিহারে ৮টি শিবির খোলা হয়েছে।
এই ২৮টি শিবিরে ইতিমধ্যেই ৫৮০০ জনকে সরিয়ে আনা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন নিচু এলাকা থেকে আরও বাসিন্দাদের সরিয়ে আনার কাজ করছে।
উত্তরবঙ্গে ইতিমধ্যেই জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (এনডিআরএফ) ৪টি দল পৌঁছে গিয়েছে। এর মধ্যে জলপাইগুড়িতে দু’টি, দার্জিলিঙে একটি এবং শিলিগুড়িতে একটি দল রয়েছে। এ ছাড়াও জলপাইগুড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছে এনডিআরএফের আরও দু’টি দল। এর বাইরে উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলায় আরও সাতটি রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা এসডিআরএফের দল রয়েছে।
নবান্ন জানিয়েছে, লাভার রংপোয় একটি পরিবার আটকে পড়ায় তাঁদের বাঁচাতে সেনা পাঠানো হয়েছে। শিবিরে আশ্রয় নেওয়া দুর্গতদের জন্য খাবার এবং পানীয় জল সরবরাহ করা শুরু হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী নবান্নের বিশেষ বৈঠকে জানিয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতির জন্য বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজ্যের মন্ত্রীদের। বৈঠকের পর নবান্ন একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, কোন মন্ত্রী কী কী দায়িত্ব পালন করবেন।
সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক, বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ-সহ অন্যান্য মন্ত্রী, জিটিএর চেয়ারম্যান অনিত থাপা, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব আইএএস অফিসার অজিত বর্ধন, কৃষি সংক্রান্ত প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ওঙ্কার মিনাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উত্তরবঙ্গে ত্রাণ এবং উদ্ধারের দায়িত্ব সামলানোর জন্য।
মুখ্যমন্ত্রী নিজে জানিয়েছেন, তিনি পরিস্থিতির দিকে ২৪ ঘণ্টা নজর রাখছেন। এই বিপর্যয়ে সেনাবাহিনীকে সমস্ত রকম সাহায্য করবে তাঁর সরকার।
অন্য দিকে, উত্তরবঙ্গের মতোই বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দক্ষিণবঙ্গেও। ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গে নিম্নচাপের কারণে ডিভিসি বিভিন্ন বাঁধ থেকে জল ছাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে মাইথন, পাঞ্চেত এবং মুকুটমণিপুরের জলাধার থেকে আরও জল ছাড়া হতে পারে বলে জানিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।
মমতা বলেছেন, মুকুটমণিপুরের বাঁধ আর জল ধরে রাখতে পারছে না। তাই আরও জল ছাড়া হতে পারে।
নবান্ন তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, দক্ষিণবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ।
হুগলিতে খানাকুল ১, ২ এবং তারকেশ্বরের একাংশ প্লাবিত। হাওড়ায় দামোদরের জলস্তর বেড়ে উদয়নারায়ণপুর এবং আমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরেরও সবং এবং ঘাটাল প্লাবিত হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে নবান্ন।
আপাতত হাওড়া, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ায় মোট ১৯০টি ত্রাণশিবির তৈরি করেছে সরকার। সরিয়ে আনা হয়েছে ৫০০০-এর বেশি মানুষকে।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দক্ষিণবঙ্গে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রী পুলক রায়-সহ একাধিক মন্ত্রীকে। এ ছাড়া হাওড়া এবং হুগলিতে দুই আমলা বরুণ রায় এবং সঞ্জয় বনসলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ত্রাণের দায়িত্ব।
হাওড়া, হুগলি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে মোট পাঁচটি এনডিআরএফ এবং আরও এসডিআরএফ দল মোতায়েন করা হয়েছে।
আপাতত নবান্ন দু’টি কন্ট্রোল রুম নম্বরের কথা জানিয়েছে।
এ ছাড়া পর্যটন দফতরের তরফেও দু’টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সমস্ত সরকারি কর্মচারীর ছুটি বাতিল বলেও ঘোষণা করেছে নবান্ন।