Savings

সম্পাদক সমীপেষু: সঞ্চয়ে এগিয়ে

যদি সেটা ধরেও নেওয়া হয়, তা হলেও আর একটি দিক উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বা ইচ্ছাকৃত ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেটি হল— স্বল্প সঞ্চয় এবং গার্হস্থ সঞ্চয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:২৯
Share:

‘গেরস্থালির খরচে পিছিয়ে বাংলা’ (২৯-১২) শীর্ষক সংবাদের নিরিখে জানতে পারলাম যে, ভোগব্যয়ের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে আছে জাতীয় গড় বা অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায়। এ প্রসঙ্গে জানাতে চাই, ব্যয় করার ক্ষমতা আসে আয় থেকে। তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, গৃহস্থালির আয় কম বলেই খরচও কম হয়েছে। ফলে ধরে নেওয়া যায়, পারিবারিক বা মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও এই রাজ্য অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সময় রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা গ্রোস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিএসডিপি) ধরা হচ্ছে না। সেটা কিন্তু ততটা হতাশাব্যঞ্জক নয়, যদিও সেই হিসাবে কারচুপি আছে বলে অভিযোগ।

Advertisement

যদি সেটা ধরেও নেওয়া হয়, তা হলেও আর একটি দিক উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বা ইচ্ছাকৃত ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেটি হল— স্বল্প সঞ্চয় এবং গার্হস্থ সঞ্চয়। এই দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ সারা ভারতে প্রথম সারিতে। সে হিসাবটা রাজ্যের নয় কেন্দ্রের, অতএব এতে রাজ্য সরকারের ভেজাল মেশানোর সুযোগ নেই বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এই সঞ্চয়ের টাকা আয়ের থেকেই এসেছে, অন্য কোনও ভাবে নয়। তাই সঠিক বিচারে পশ্চিমবঙ্গের পারিবারিক বা মাথাপিছু আয় হিসাব করতে হবে ব্যয় এবং সঞ্চয়, দুটো যোগ করে। যে সঞ্চয়ের দিক থেকে এই রাজ্য আবার অন্যান্য রাজ্যের থেকে এগিয়ে। এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, এ রাজ্যের মানুষ আয়ের থেকে ভোগব্যয় কিছুটা সংযত করে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ও করে। দুটো অঙ্ক যোগ করলে আয়ের চিত্রটা ততটা খারাপ হবে বলে মনে হয় না, যতটা দেখানো হচ্ছে। বরং ভবিষ্যৎ সচেতনতা ও জাতির অগ্রগতিতে অংশগ্রহণে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এগিয়ে। কারণ এই স্বল্প সঞ্চয়ের টাকা সরকারি জন উন্নয়নের কাজে লগ্নি হয়।

আশিস সেনগুপ্ত, কলকাতা-৩৭

Advertisement

পিছিয়ে রাজ্য

‘অসাম্য কমল কি’ (৭-১) সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। দেশে গৃহস্থালি খরচের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, শহর ও গ্রামের মাথাপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে জাতীয় গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে আছে। সমীক্ষার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছে যে, শহর ও গ্রামে মাথাপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যবধান কমেছে। অর্থাৎ, দেশে অসাম্য কমেছে। মাথাপিছু ব্যয় বৃদ্ধি তথা শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যয়ের ব্যবধান হ্রাস অবশ্যই দেশের আর্থিক উন্নতির সূচক।

কিন্তু সম্পদ ও আয় কার হাতে কতটা আছে, সেটি কোনও দেশের মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থান জানতে সাহায্য করে। অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া-র রিপোর্ট অনুযায়ী, এ দেশের মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে উপরের তলার ১০ শতাংশ মানুষের হাতে জাতীয় সম্পদের ৭৭% মালিকানা আছে। আবার দেশের অর্ধেক মানুষের হাতে এই মালিকানার হার ৪.১%। ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট, ২০২৩ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যার একেবারে উপরের তলার ১০ শতাংশ ও ১ শতাংশের হাতে দেশের মোট কর-পূর্ব আয়ের ৫৭ ও ২২ শতাংশ আছে; এবং নীচের তলার ৫০ শতাংশের হাতে আছে মাত্র ১৩%।

অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করতে গেলে সম্পদ এবং আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে দূর করার উপর জোর দিতে হবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বায়ন, উদারীকরণ, ও বেসরকারিকরণ মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা আনার পরিবর্তে বৈষম্যকেই বাড়িয়ে তুলেছে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়।

নারায়ণ দত্ত, বর্ধমান

সর্বগ্রাসী দুর্নীতি

অমিতাভ গুপ্ত-র ‘ঘরে ও বাইরে লড়াই’ (৩০-১২) শীর্ষক প্রবন্ধের শুরুতেই উত্থাপিত সংশয়াত্মক প্রশ্নের— ‘পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কি তবে পৌঁছে গেল এমন একটি স্তরে, যেখানে দুর্নীতি সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে?’— উত্তরটি ইতিবাচক। ‘পরিবর্তন চাই’ স্লোগানে ও বিভিন্ন কাট আউটে সততার প্রতীক হিসাবে জনতার মন জিতে ক্ষমতায় আসা দলটি বঙ্গ রাজনীতিতে প্রথমেই যে মৌলিক পরিবর্তনটি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে তা হল— ছোট, বড়, মাঝারি ইত্যাদি সব ধরনের চুরি, দুর্নীতিতে শাসক দলের বহুস্তরীয় নেতা, মন্ত্রীদের জড়িয়ে ফেলা। সেই সঙ্গে আদালত, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দলগুলির বডিলাইন বাউন্সার মসৃণ ভাবে ‘ডাক’ করার কৌশল রপ্ত করা এবং নির্বাচনগুলিতে বিপুল জনাদেশ অর্জন করে দুর্নীতিকে সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ এবং সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা। যদিও এখন আর কোনও নির্বাচনেই শাসক দলকে ‘সততার প্রতীক’ কাট আউট সাজিয়ে অবতীর্ণ হতে দেখা যায় না।

ভোটারদের প্রভাবিত করতে কম-বেশি সব দলকেই ‘অনুদান’নির্ভর রাজনীতি করতে দেখা যায়। মহিলাদের নিখরচায় বাসভ্রমণ থেকে লাডলী বহনা-এর মতো প্রকল্প, দু’টাকা কিলো দরে চাল বিতরণ থেকে মহালক্ষ্মী যোজনা— অন্তত দু’ডজন অনুদাননির্ভর প্রকল্প চালু রয়েছে এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। রেউড়ি সংস্কৃতিতে স্থায়ী সম্পদ তৈরি হয় না বলে কটাক্ষ করেও প্রকাশ্যে বন্ধ করার সাহস কেউ দেখাতে পারেননি। সরাসরি অর্থ প্রদান নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও পৃথিবীর বহু দেশে এই ধরনের প্রকল্প চালু রয়েছে। সুতরাং, রাজ্য সরকার এই সব বিষয়ে গলা চড়ালেও নতুন কিছু আমদানি করেনি। যা করেছে তা হল প্রকল্পের নামকরণের মাধ্যমে মানুষের অন্দরমহলে পৌঁছে যাওয়া এবং বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে এই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে বলে সযত্নে ভোটারদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া। নিঃসন্দেহে বলা যায় পরবর্তী নির্বাচন বিজ্ঞপ্তি জারির ঠিক আগে এই প্রকল্পে ভাতা বৃদ্ধি ঘটতে চলেছে।

সিঙ্গুরের ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার ট্র্যাক রেকর্ড নিয়ে ক্ষমতায় এসে মা-মাটি-মানুষের সরকার বুঝে নিয়েছে, এ রাজ্যে জমি অধিগ্রহণ করা আত্মহত্যার শামিল। তবে, বৃহৎ শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে একলপ্তে কর্মসংস্থানের পরিবর্তে চপ ভাজার পরামর্শ বা কাশফুল দিয়ে পাশবালিশ তৈরির নিদান, সঙ্গে ক্লাব, পুজো কমিটি, পুরোহিত ভাতা চালু করে বৃহৎ সংখ্যক ভোটারকে প্রভাবিত করার এক নিপুণ চিত্রনাট্য গড়েছে তারা। যে রাজ্যের কন্যাশ্রী প্রকল্প আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়, সেই রাজ্যেই নাবালিকা বিবাহ বা নারী পাচার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বার বার উঠে আসা খুবই আশ্চর্যের। এই নিয়ে কেউ প্রশ্নও তোলে না।

শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অজস্র। খাপ পঞ্চায়েত গোছের মনসবদারি সংবাদমাধ্যমের সূত্রে উঠে আসায় প্রশাসনিক গাফিলতি ক্রমশ বে-আব্রু হয়ে ওঠে। ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। নিয়মিত চাকরির বন্দোবস্ত করতে সরকার ডাহা ফেল, আদালতের আঙিনায় যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা মাথা কুটছেন। বাড়ছে ঠিকা শ্রমিক, সিভিক ভলান্টিয়ার, প্যারা টিচার, প্যারা ডাক্তার, বিভিন্ন অ্যাপনির্ভর পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত গিগ শ্রমিকের সংখ্যা। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সব উপকরণ থাকা সত্ত্বেও কেবল লক্ষ্মীর ভান্ডারের জোরে শাসক দল বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে বলে অনেকেরই অভিমত।

এ ছাড়াও রয়েছে সহজ পাটিগণিত। কেন্দ্রে বিজেপির শাসন ও তাদের বিভেদমূলক রাজনীতি, মুয়াজ্জিন-ইমাম ভাতা ইত্যাদি অনুদানের জেরে রাজ্যের ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোটের সিংহভাগ যায় তৃণমূলের ঝুলিতে। বাকি ৭৩ শতাংশ অ-মুসলিম ভোটের কম-বেশি পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা ভোটার। লক্ষ্মীর ভান্ডারের কারণে মহিলা ভোটের এক বড় অংশ শাসক দলের অনুকূলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অর্থাৎ, যে কোনও নির্বাচনের শুরুতে মুসলিম ও সংখ্যাগুরু মহিলা ভোটের গ্যারান্টি নিয়ে শাসক দল নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়, ‘মোদীর গ্যারান্টি’ও এ কারণে খুব বেশি দাগ কাটতে পারে না।

এক জন মানুষ গর্তে পড়ে গেলে তাঁকে দু’ভাবে উপকার করা যায়— দিনে দু’বেলা গর্তে খাবার ও জল পাঠিয়ে; অথবা হাত ধরে টেনে উপরে তুলে এনে। প্রথমটি অনুদান আর পরেরটি উন্নয়ন। এই অনুদান, বিজেপি জুজু ও যে কোনও দুর্নীতির তদন্তকে কানাগলিতে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য ‘সেটিং’ (মতান্তরে) হল শাসক দলের ট্রাম্প কার্ড। মমতা-অভিষেকের নামে শীর্ষস্তরের তথাকথিত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আসলে কমিক রিলিফ, যে কোনও জ্বলন্ত সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

রাজশেখর দাশ, কলকাতা-১২২

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement