State Government

‘মা ফলেষু কদাচন?’

ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গার (এনএমসিজি) প্রকল্প ‘নমামি গঙ্গে’। উদ্দেশ্য: গঙ্গা নদীর পুনরুজ্জীবন, সুরক্ষা ও পরিচালনা।

Advertisement

অশোক কুমার লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:৪৫
Share:

কর্মযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা-য় বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ: ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন’। অর্থাৎ, আমাদের কর্মের উপরে অধিকার আছে, ফলের উপরে নয়। অর্থ অত্যন্ত গূঢ়। আমার সব সময়ই মনে হয় যে, এই উপদেশ সঠিক ভাবে অনুসরণ করা তো দূরের কথা, সঠিক অর্থটা বোঝাও অতি দুষ্কর। এই শ্লোকের টিপ্পনী লেখার জ্ঞানৌচিত্য বোধ আমার নেই।

Advertisement

কিন্তু আমাদের রাজ্য সরকারের কাজের ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে এ কথা মনে হতেই পারে যে, সরকার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলছে। অর্থাৎ, টাকা খরচ করছে, কাজ করছে— কিন্তু, তার পর ফল কী হচ্ছে, সে সম্বন্ধে তিলমাত্র উদ্বিগ্ন হচ্ছে না। যেমন ধরুন, সরকার স্কুল-খাতে টাকা খরচ করছে, স্কুলবাড়ি বানাচ্ছে, এবং যথাযথ শিক্ষক নিয়োগ করে বা না-করেই স্কুল চালাচ্ছে। কিন্তু, তার পরে পঞ্চম শ্রেণির বাচ্চারা পড়তে, লিখতে, যোগ-বিয়োগ করতে পারছে কি না, সে সম্বন্ধে সরকার আদৌ বিচলিত হচ্ছে না। বড় বাড়ি বানিয়ে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল বলে চালাচ্ছে। তাতে ডাক্তার, ওষুধ আছে কি না, এবং যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষের রোগ নিরাময় হচ্ছে কি না, সে খোঁজ নিচ্ছে না। গ্রামে রাস্তা বানাচ্ছে। পুকুরপাড়ের সেই রাস্তা পরের বছর বর্ষার সময় পাড় ভেঙে পুকুরগর্ভে চলে গেল কি না সে বিষয়ে— কর্মযোগী হয়েও— সম্পূর্ণ উদাসীন থাকছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সরকারি কর্মের পরিণাম বা ফলের বিষয়ে আরও অনেক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। কাজটা যদিও সহজ নয়। সরকারি সংস্থা, বিশেষত সরকারের যে বিভাগ একটি প্রকল্প নির্বাহ করছে, তাদেরই ফলাফল বিচারের দায়িত্ব দিলে স্বার্থের সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিজের প্রকল্পের ফল আশানুরূপ হয়নি, সেই কথাটা কোনও সরকারি বিভাগের পক্ষে স্বীকার করা কঠিন। অন্য দিকে, বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে এই মূল্যায়ন করলে, এই মূল্যায়নের গুণমান সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠতে পারে। এই অবস্থায় প্রয়োজন দু’টি পৃথক মূল্যায়ন— একটি সরকারি প্রোগ্রাম মনিটরিং, অর্থাৎ প্রকল্পের গুণমান পর্যবেক্ষণ দফতরের দ্বারা; এবং দ্বিতীয়টি বেসরকারি কোনও সমীক্ষা সংস্থা দ্বারা। প্রয়োজন এই দু’টি মূল্যায়নের তুলনা, এবং র‌্যান্ডম স্যাম্পলিং মারফত দু’টি সমীক্ষার নির্ভরযোগ্যতা নির্ধারণ করা।

Advertisement

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, গত মাসের শেষ দিকে এই সংবাদপত্রে ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প সম্বন্ধে একটি খবর পড়ে আশান্বিত হলাম। খবরটির শিরোনাম: ‘সাত বছরে বসেছে ২২ লক্ষ গাছ! কিন্তু গুনছে কে?’ গাছ লাগানো ব্যাপারটাকে নিষ্কাম কর্ম হিসাবে ধরে নিলে, সরকারের টাকা খরচ হবে, কাজের কাজ কিছু হবে না। ভাবা প্রয়োজন যে, এই প্রকল্পের গতি কোন দিকে হওয়া বিধেয়। গঙ্গা নদীর পুনরুজ্জীবন, সুরক্ষা ও সুষ্ঠু পরিচালনা দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রকল্প। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরনের কাজে দশকের পর দশক লেগে গিয়েছে বা যাচ্ছে। যেমন ব্রিটেনে টেমস এবং চিনে ইয়াংসি নদীর পুনরুজ্জীবন ও সুরক্ষার প্রকল্প। কিন্তু প্রতি বছর আমরা যা করছি, তা যদি নিষ্কাম কর্ম এবং বৃথা হয়, তবে আমরা কোনও দিনই গঙ্গাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারব না।

ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গার (এনএমসিজি) প্রকল্প ‘নমামি গঙ্গে’। উদ্দেশ্য: গঙ্গা নদীর পুনরুজ্জীবন, সুরক্ষা ও পরিচালনা। এই প্রকল্পে আছে গঙ্গায় ফেলার আগে শিল্পের বিষাক্ত ও রাসায়নিক বর্জ্যের প্রবেশ রোধ; গৃহস্থালির পয়ঃনিষ্কাশন পরিশোধনের জন্য সিউয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এসটিপি) স্থাপন; ভূপৃষ্ঠের প্রবাহ এবং ভূগর্ভস্থ জলের পুনরুদ্ধার ও তা বজায় রাখা ইত্যাদির সঙ্গে স্থানীয় এলাকার প্রাকৃতিক গাছপালা পুনরুজ্জীবন এবং রক্ষণাবেক্ষণ।

গঙ্গার ধারাকে অবিরল এবং নির্মল করার যুগল উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার মধ্যে অন্যতম সবুজায়ন অর্থাৎ বৃক্ষরোপণ। বৃক্ষরোপণে বিভিন্ন ধরনের দূষকের নদীর জলে প্রবেশ রোধ হয়, অনেক পাখি ও প্রাণীর খাদ্যের উৎস এবং আশ্রয় তৈরি হয়, ও নদীর তীরবর্তী মাটির ক্ষয় রোধ হয়ে নদীতে পলির সমস্যা হ্রাস হয়।

গঙ্গা নদীর পুনরুজ্জীবন, সুরক্ষা ও পরিচালনার জন্য উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের নদীতীরে বৃক্ষরোপণের কাজ হচ্ছে ফরেস্ট্রি ইন্টারভেনশন প্রোজেক্টের অধীনে। সূত্র অনুসারে, এনএমসিজি-র সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে নদীতীরে ২০১৬-১৭ সাল থেকে ২,১১৫ হেক্টর সবুজায়ন করা হয়েছে। গত সাত বছরে ‘নাম্বার অব প্লান্টস’ বা বসানো গাছের জায়গায় যে ২২,১৮,৪৪৯ সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি প্রশংসনীয়। অনেকে প্রশ্ন করছেন, কোথা থেকে এল এত গাছের চারা? প্রশ্নটি যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আমার প্রশ্ন সেটা নয়, অন্য। আমার প্রশ্ন: এই ২২ লক্ষের বেশি গাছ, যেগুলি লাগানো হয়েছে, সেগুলি যেখান থেকেই আসুক, শেষ অবধি বেঁচে আছে কি? তাদের শারীরিক অবস্থা কেমন? কেউ দেখছে কি?

সুসংবাদ হচ্ছে যে, এই গাছ গণনার জন্য আগের যুগের মতো কোনও বিশাল সার্ভেয়র বা পরিমাপক দলের প্রয়োজন নেই। ড্রোন প্রযুক্তি গাছ গণনার পদ্ধতিতে বিপ্লব এনেছে। ড্রোন বন পর্যবেক্ষণ, জীববৈচিত্র ট্র্যাকিং এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার মূল্যায়নে একটি দ্রুত ও প্রায় ত্রুটিহীন উপায় প্রদান করছে। উন্নত সেন্সর এবং উচ্চ রেজ়লিউশনের ক্যামেরাসমৃদ্ধ এই উড়ন্ত যন্ত্রগুলি বিশাল ভূখণ্ড স্ক্যান করে অবিশ্বাস্য নিখুঁত ভাবে গাছ শনাক্ত ও তালিকাভুক্ত করতে পারে।

রাজ্যের বন দফতর ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে, কোথায় কত এবং কোন ধরনের গাছ কতটা বড় হয়েছে তার তালিকা এবং আকাশ-চিত্র বা এরিয়াল ফোটোগ্রাফ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করলেই আমরা সবাই জানতে পারব যে, পশ্চিমবঙ্গে নমামি গঙ্গের বৃক্ষরোপণ কর্মযোগ কতটা সফল বা নিষ্ফল হয়েছে। এখন অবধি সফল হয়ে থাকলে আমরা সবাই আহ্লাদিত হব।

আর, নিষ্ফল হয়ে থাকলে? তখন কি শুধু গীতার শ্লোক ‘মা ফলেষু কদাচন’-র শরণ নিয়ে নিজেদের প্রবোধ দেব?

না, শুধু প্রবোধ দিলে চলবে না। সরকারি টাকায় গাছের চারা কিনে লাগিয়ে দায় সারলে চলবে না। তার পর শুধু সরেজমিনে ড্রোন দিয়ে তার ক’টি বেঁচে আছে, তাদের শারীরিক অবস্থা কী, তার সমীক্ষা করলেই চলবে না। ভবিষ্যতে গাছের চারা লাগালে তারা যাতে সুস্থ ভাবে বেঁচে থেকে বড় হয়, বিভিন্ন ধরনের দূষকের নদীর জলে প্রবেশ রোধ করে, অনেক পাখি ও প্রাণীর খাদ্যের উৎস এবং আশ্রয় তৈরি করে ও নদীর তীরবর্তী মাটির ক্ষয় রোধ করে নদীতে পলির সমস্যা হ্রাস করে, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে।

গাছ অনেকটা মানবশিশুর মতো। শৈশবে তাদের লালনপালন দরকার। খরা হলে দরকার জল সেচ। মানবশিশুকে যেমন চলমান গাড়ি অপিচ দুষ্ট লোকের কুসঙ্গ থেকে বাঁচাতে হয়, তেমনই দরকার গাছগুলোকে গরু-ছাগলের হাত থেকে বাঁচানো। এর জন্য দরকার চারাগাছগুলির আশেপাশের গ্রামগুলির মহিলাদের এই লালন-পালনে সংযুক্ত করার। তাতে খানিক কর্মসংস্থানও হবে। এই মহিলাদের প্রত্যেককে ৪০-৫০টি গাছের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। এই কাজের জন্য, প্রতি তিন মাস অন্তর ড্রোন দ্বারা গাছগুলির বৃদ্ধির হার যাচাইয়ের পরে, তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া যেতে পারে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি প্রকল্প থেকে।

আমার ধারণা, এই পন্থা অবলম্বন করলে বেশির ভাগ সময় আমাদের আর নিষ্ফল হয়ে ‘মা ফলেষু কদাচন’-র শরণ নিতে হবে না। এই পরিণাম সমীক্ষার পন্থাটি শুধু গঙ্গার তীরের গাছগুলির গেরস্তালির জন্যে নয়, সকলের উন্নয়নে কাজে লাগুক, এই আশা তো করতেই পারি নতুন বছরে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement