গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পারিবারিক কেচ্ছা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জায়গা পাচ্ছে কেন? স্ত্রী-র সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের প্রসঙ্গ কেন বলা হচ্ছে দলের রোড-শোয়ে যোগ দিয়ে? এমন প্রশ্নে শোভন চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে ক্ষুন্ন রাজ্য বিজেপি নেতারা। গেরুয়া শিবির সূত্রের খবর, এই ধরনের বিষয় নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে বলা ঠিক হচ্ছে না বলে ইতিমধ্যেই দলের পক্ষে কলকাতা জোনের পর্যবেক্ষক শোভনকে জানানো হয়েছে। একই বার্তা দেওয়া হয়েছে শোভন-বান্ধবী বৈশাখীকে। গেরুয়া শিবির সূত্রে খবর, রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সরাসরি কথা না বললেও নির্দিষ্ট নেতাদের মাধ্যমে শোভনকে এমন বার্তাও দিয়েছেন যে, দলীয় কর্মসূচিতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় উল্লেখ করা যাবে না। এতে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। তবে এ নিয়ে তাঁদের বক্তব্য জানতে বারংবার বৈশাখীর ফোনে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি। টেক্সট মেসেজেরও জবাব দেননি তিনি।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি শোভনের বিরুদ্ধে মানহানীর মামলা করেছেন তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়। অভিনেত্রী-বিধায়কের বিধানসভা কেন্দ্র রায়দিঘিতে বিজেপি-র একটি সভায় দেবশ্রী সম্পর্কে শোভনের কিছু মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই ওই মামলা। সেই রাজনৈতিক লড়াইয়ে শোভন-বৈশাখীর পাশেই ছিল দল। কিন্তু দেবশ্রী আলিপুর আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে শোভন ও বৈশাখী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন, তার জবাব দেওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। বিজেপি-র রোড-শো চলাকালীন দলের ট্যাবলোয় দাঁড়িয়েই পাল্টা মন্তব্য করেন শোভন-বৈশাখী। একই সঙ্গে শোভন তাঁর শ্বশুরমশাই তথা মহেশতলার তৃণমূল বিধায়ক দুলাল দাসের বিরুদ্ধেও আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন। যার অনেকটাই ছিল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক। স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কেও দলীয় মঞ্চ থেকেই আক্রমণ শানিয়েছিলেন শোভন। আর সেই আক্রমণের প্রসঙ্গ ‘অশোভন’ ছিল বলেই মনে করছেন বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্ব।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি আলিপুর আদালতে মামলা করতে গিয়েছিলেন দেবশ্রী। তখন তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘শোভন চট্টোপাধ্যায় মতো মানুষেরা সামাজিক অস্বস্তি। পরিবার, সন্তানের কাছে, স্ত্রী-র কাছে যে আপন নয়, সে কত বড় নেতা! সে কি জনপ্রিয় নেতা হতে পারে! মানুষের সামনে দাঁড়াতে পারে?’’ সেই দিনই দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলায় বিজেপি-র রোড শোয়ে যোগ দেন শোভন-বৈশাখী। দলের ট্যাবলোয় দাঁড়িয়েই দু’জন আক্রমণ করেন দেবশ্রীকে। তাঁর পরিবার নিয়ে দেবশ্রী যে প্রশ্ন তুলেছেন, তার জবাবে শোভন বলেন, ‘‘উনি সন্তানের মা নন। আর সংসার? ওঁর যে সংসার ছিল, তার কী পরিণতি হল, সেটা যেন মানুষের কাছে খোলসা করেন। আমি তো নির্দিষ্ট অভিযোগ এনে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করেছি। সেই মামলা চলছে...। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি! কথায় বলে, সে কে? ডাইনি।’’
শোভন দুলাল ও স্ত্রী রত্না সম্পর্কেও নানা পারিবারিক ‘কেচ্ছা’-র উল্লেখ করেন বিজেপি-র মঞ্চ থেকেই। তিনি বলেন, ‘‘দুলাল দাসের অনেক দ্বিচারিতা রয়েছে। এখানে ওঁর অনেক গুদামঘর রয়েছে। সেই সব গুদামঘরের একাংশের জমির মালিকানা আমার। আমার প্রাপ্য টাকার হিসাব করা হলেও তিনি এখনও তা দেননি। উনি বলেন, মেয়ের ভরণপোষণ করবেন। তাই ওঁর টাকা দরকার। কিন্তু ওঁর মেয়ে সংসার করার মেয়ে নন। ওঁর সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই আমি ছেড়ে চলে গিয়েছি। তখন তো উনি বলেছিলেন, মেয়েকে বসিয়ে খাওয়াবেন। তা হলে আমার অর্থ কেন আটকে দিয়েছেন?’’ শোভন আরও বলেন, ‘‘ রত্নাদেবী দিনে একবার আমায় টেলিফোন করতেন। আর একশোবার কাকে ফোন করতেন, তার খোঁজ নিয়ে দিন দুলাল দাস!’’
শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ওই পারিবারিক বাক্যালাপ ভাল চোখে দেখেনি রাজ্য বিজেপি। দুই মহিলা সম্পর্কে দলীয় কর্মসূচি থেকে যে ধরনের ভাষা শোভন ব্যবহার করেছেন, তা অশোভন বলে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও অনুযোগ জানানো হয়েছে বলেই খবর। রাজ্য বিজেপি এক নেতা জানিয়েছেন, এমনিতেই ওঁদের ‘সম্পর্ক’ নিয়ে নানা রসালো মন্তব্য শুনতে হচ্ছে। ওঁদের কাণ্ডকারখানা নিয়ে দলের মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়ছেন। এমনিতে আমরা ওঁদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করি না। অন্যরা করুক, তা-ও চাই না। কিন্তু এ বার ওঁরা যেটা করেছেন, তাতে তৃণমূল বিজেপি-র সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ওঁদের সম্পর্ক ভাঙা-গড়া নিয়ে ওঁরা থাকুন। দলকে মাঝখানে রাখার দরকার কী?’’
প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের উপস্থিতিতে আলিপুর আদালতে গিয়ে শোভন-জায়া রত্না দেবশ্রীর হয়ে সাক্ষী দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। রত্না বলেছেন, ‘‘দেবশ্রী আমাদের খুব ভাল পারিবারিক বন্ধু। আমার সঙ্গে এবং শোভনের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু দেবশ্রী কোনও দিনই আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ঢোকেননি।’’ অর্থাৎ, প্রকারান্তরে রত্নার অভিযোগ ছিল, বৈশাখী তাঁর এবং শোভনের সম্পর্কের মধ্যে ‘ঢুকেছেন’।
নীলবাড়ি দখলের লড়াইকে ‘এবার নয় নেভার’ মনোভাব নিয়ে দেখছে বিজেপি। শুধু রাজ্য নেতারা নয়, কেন্দ্রীয় নেতারাও সেই লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন। বিধানসভা নির্বাচন যখন দোড়গোড়ায় তখন শোভন-বৈশাখীর সাম্প্রতিক মন্তব্য নিয়ে বিজেপি যে অস্বস্তিতে তা স্পষ্ট ভাষাতেই বলছেন রাজ্য নেতাদের একাংশ। দলের এক শীর্ষ নেতা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘দেবশ্রী রায়কে নিয়ে ওঁদের আপত্তি অনেকদিন থেকে। বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার আগের মুহূর্তেও আমাদের অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল। নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল দিল্লির সদর দফতরে। এখন সেই বিবাদ বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে নিয়ে আসাটা দলের ক্ষতিই করছে।’’ ওই নেতা জানিয়েছেন, সঙ্ঘ পরিবারও বিষয়টাকে ভাল চোখে দেখছেন না। সেটাও জানানো হয়েছে ওঁদের। রাজ্য বিজেপি-র অনেকে মনে করছেন এই বার্তার পরেই নিজেদের আড়ালে রেখেছেন শোভন-বৈশাখী।