—প্রতীকী ছবি।
বিধানসভা ভোটে আসনের নিরিখে আপাতত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধার ঘেঁষে রয়েছে তৃণমূল। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার নির্দিষ্ট অঙ্ক থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছুটা পিছিয়ে। আর বাম-কংগ্রেস জোট এবং অন্যদের সকলকে নিয়েও সম্ভাব্য আসনের সংখ্যা বড়জোর ৩০। সোমবার এবিপি আনন্দ-সিএনএক্স-এর সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষায় এই চিত্র ফুটে উঠেছে।
রাজ্যে বিধানসভার মোট আসন ২৯৪। তবে বর্তমান সমীক্ষায় রাজ্যের সব ক’টি অর্থাৎ ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রকে ভিত্তি করে তার অন্তর্গত ১১২টি বিধানসভা কেন্দ্র বেছে নেওয়া হয়েছে। মহিলা ও পুরুষ মিলিয়ে কথা বলা হয়েছে ৮ হাজার ৯৬০ জনের সঙ্গে। ২৩ জানুযারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এই ধরনের সমীক্ষা সব সময়ই স্বীকৃত পদ্ধতি মেনে করা হয়। তবে তাতে কিছু অনিশ্চয়তাও থাকে। তাই সমীক্ষার ফলাফল যা-ই হোক, সেটা চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়ার কারণ নেই। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়কালে নেওয়া জনমতের এক প্রতিফলন মাত্র।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, তৃণমূল জিততে পারে ১৪৬ থেকে ১৫৬ আসন। একক শক্তিতে সরকার গঠনের জন্য যে কোনও দলের দরকার কমপক্ষে ১৪৮ আসন। সে দিক থেকে সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, তৃণমূলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যায়। আবার রাজ্যে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়া বিজেপি, এই সমীক্ষা অনুযায়ী, ১১৩ থেকে ১২১ আসন পেতে পারে। যা ১৪৮-এর থেকে অনেকটাই কম। এই সমীক্ষায় বাম-কংগ্রেস জোটের সম্ভাব্য আসন ২০ থেকে ২৮। এবং অন্যান্য (গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ইত্যাদি) পেতে পারে ১ থেকে ৩টি।
পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, প্রকৃত ফলাফল যদি এই সমীক্ষার প্রবণতার সঙ্গে মিলে যায়, তা হলে কোয়ালিশন সরকার গড়ার সম্ভাবনাও হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর যদি তেমন পরিস্থিতি আসে সে ক্ষেত্রে বাম-কংগ্রেস জোটের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ অবশ্য এটাও মনে করেন, এই ধরনের ফলে ভোট পরবর্তী ‘কেনা-বেচা’র পথও খুলে যেতে পারে।
তবে এ সবই জল্পনা। কারণ অনেক সময়ই সমীক্ষা শেষ কথা বলে না। তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী তাপস রায় বলেন, ‘‘সমীক্ষা যা-ই বলুক, আমরা নিশ্চিত, বাংলার মানুষ শান্তি এবং উন্নয়নের পক্ষে ভোট দেবেন। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার সরকার গড়বেন।’’
রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এখনও নির্বাচন ঘোষণা হয়নি। নির্বাচনী আচরণ বিধি লাগু হয়নি। এখনই যদি সমীক্ষায় বিজেপির এই ফল আসে, তা হলে তো বোঝাই যাচ্ছে কী হতে চলেছে! অবাধ, শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য মানুষ অপেক্ষা করছেন। সেটা হবে এবং বিজেপি ২০০-র বেশি আসন জিতে সরকার গড়বে।’’
বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সব সময় বলা হয়, বামেদের দূরবীণ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এই সমীক্ষা সত্য হলে তৃণমূল এবং বিজেপি— দু’পক্ষেরই ভোট প্রাপ্তির হার এক শতাংশ করে কমেছে এবং বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট প্রাপ্তির হার পাঁচ শতাংশ করে বেড়েছে। এখান থেকেই মানুষের প্রবণতা স্পষ্ট।’’
বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ, লোকসভা ভোটে তার ফায়দা অনেকটাই পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু লোকসভা এবং বিধানসভার ভোট এক নয়। মানুষ এখানে তৃণমূল বা বিজেপি— কোনও পক্ষকেই একচেটিয়া সমর্থন দেবেন না। যত দিন যাচ্ছে, ওই দুই দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষ বাম-কংগ্রেসরে দিকে আসছেন। ভোটেও তার প্রতিফলন হবে।’’
এর আগে জানুয়ারির মাঝামাঝি সি ভোটার-এবিপি আনন্দ-এর অন্য একটি সমীক্ষায় তৃণমূলের একক গরিষ্ঠতা পাওয়ার ইঙ্গিত ছিল। সেখানে তৃণমূলের সম্ভাব্য আসন ছিল ১৫৪ থেকে ১৬২। বিজেপি ছিল অনেকটাই কম— ৯৮ থেকে ১০৬। তুলনায় বেশি ছিল বাম-কংগ্রেস জোট— ২৬ থেকে ৩৪। এ বার সিএনএক্সের সমীক্ষা থেকে বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেস জোট, উভয়েরই আসন কমেছে। আর বেড়েছে বিজেপির।
গত এক মাসের মধ্যে তৃণমূলে আরও কিছু ভাঙন দেখা গিয়েছে। মন্ত্রী, বিধায়ক-সহ অনেকেই শিবির বদল করে গেরুয়া পতাকা ধরেছেন। রাজ্যে আনাগোনা বেড়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার। পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা জেলায় বড় বড় সভা-সমাবেশ করছেন। তা সত্ত্বেও বর্তমান সমীক্ষা অনুযায়ী, এই দু’দলের কারওরই সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছতে না পারার যে সম্ভাবনা ধরা পড়ছে, তা অর্থবহ।
ভোটের শতাংশ বিচারে এখন সিএনএক্স এবং আগে সি ভোটারের দু’টি সমীক্ষার তুলনামূলক পর্যালোচনাতেও দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল ও বিজেপি— দুই দলেরই ভোট এক শতাংশ করে কমে যেতে পারে। যেমন সি ভোটারের সমীক্ষায় তৃণমূলের ভোট শতাংশ ছিল ৪৩, বিজেপির ৩৮। এ বার সিএনএক্সের জনমত সমীক্ষায় তা হয়েছে যথাক্রমে ৪২ ও ৩৭। তবে লক্ষণীয় হল, বর্তমান সমীক্ষায় আসাদুদ্দিন ওয়েইসির সংগঠন এমআইএম ১ শতাংশ ভোট পেতে পারে বলে ইঙ্গিত রয়েছে। অন্যান্যরা পেতে পারে ৩ শতাংশ। অনেকের ধারণা, অন্যদের মধ্যে আব্বাস সিদ্দিকীর মতো কেউ কেউ ভোটের ভাগীদার হতে পারেন। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল, বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট শতাংশ অনেকটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। সি ভোটারের সমীক্ষায় যা ছিল ১২ শতাংশ, সিএনএক্সের সমীক্ষায় তা বেড়ে হয়েছে ১৭। অর্থাৎ, সিএনএক্সের সমীক্ষার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, জোটের আসন সংখ্যা কমলেও ভোট কেটে নেওয়ার সম্ভাবনা ক্রমবর্ধমান।
পছন্দের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অবশ্য মমতাই জনপ্রিয়তায় এগিয়ে। তবে সে ক্ষেত্রেও একটি অবনমন ধরা পড়ছে। যেমন মধ্য জানুয়ারিতে সি ভোটারের জনমত সমীক্ষায় মমতার জনপ্রিয়তা ছিল ৫২ শতাংশ। এখন সিএনএক্সের সমীক্ষা অনুযায়ী তা কমে হয়েছে ৩৮। তার পরেই আছেন বিজেপির দিলীপ ঘোষ। জনপ্রিয়তা কমেছে তাঁরও। বর্তমান সমীক্ষার নিরিখে ১৯, যা এক মাস আগের সমীক্ষায় ছিল ২৫।
বর্তমান সমীক্ষা বলে, ৮০ শতাংশ মানুষ ২০১৯ সালের লোকসভায় যে দলকে ভোট দিয়েছিলেন, এ বার বিধানসভাতেও তাকেই ভোট দিতে চান। গত লোকসভায় তৃণমূল পেয়েছিল ২২টি আসন। বিজেপি ১৮টি। বিধানসভার নিরিখে তৃণমূল তাতে এগিয়ে ছিল ১৬৫ ও বিজেপি ১২১ টি আসনে। সিএনএক্সের সমীক্ষা যে সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়, তাতে বিজেপির সর্বোচ্চ ১২১টি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা লোকসভার হিসেবের গণ্ডি পেরোতে পারছে না। অন্য দিকে, শাসক তৃণমূল যদি সর্বোচ্চ ১৫৬ আসন পায়, তা হলেও তা লোকসভার নিরিখে প্রাপ্য আসনের তুলনায় কিছুটা কম। তবে এ ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ মানুষ তাঁদের মতামত জানাননি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিচারে এটি সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।