West Bengal Panchayat Election 2023

প্রত্যাশার উত্তরবঙ্গেও বিপর্যস্ত হাল বিজেপির! নেতৃত্বের ব্যাখ্যা: ভোট নয়, প্রহসনের ফল

আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি বা খোদ রাজ্য সভাপতির জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরে এতটা খারাপ ফল হবে, ভাবেনি বিজেপি। আলিপুরদুয়ার, দক্ষিণ দিনাজপুরে একটিও জেলা পরিষদ আসন পায়নি তারা।

Advertisement

নিলোভনা চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ ২১:২৮
Share:

সুকান্ত মজুমদার। গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।

দক্ষিণবঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রামের মতো কিছু জেলায় আশা ছিল। কিন্তু বড় ভরসা ছিল প্রায় গোটা উত্তরবঙ্গ। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের অনেকেই আশা করছিলেন, উত্তরবঙ্গে একাধিক জেলা পরিষদ তাদের দখলে আসতে পারে। কারণ শেষ দুই বড় ভোটে, শাসকদল তৃণমূলের সঙ্গে শুধু টক্কর দেওয়াই নয়, অনেক ক্ষেত্রে টেক্কাও দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু মঙ্গলবার গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের ফলাফল প্রকাশ হতেই সেই প্রত্যাশা তলানিতে ঠেকতে শুরু করেছিল। আর বুধবার জেলা পরিষদের ফল যখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, তখন তা মাটিতে মিশে যায়। আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি বা খোদ রাজ্য সভাপতির জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরে এতটা খারাপ ফল ভাবতে পারেননি কেউই। আলিপুরদুয়ার এবং দক্ষিণ দিনাজপুরে একটিও জেলা পরিষদ আসন জিততে পারেনি বিজেপি। দলের নেতারা অবশ্য এই হারের পিছনে দু’টি কারণ দেখাচ্ছেন। এক, ভোটের আগে এবং ভোটের দিনের সন্ত্রাস। দুই, গণনায় কারচুপি।

Advertisement

২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বাংলায় ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। উত্তরবঙ্গে আটটি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি জেতে সাতটি। আলিপুরদুয়ার, বালুরঘাট, কোচবিহার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, মালদহ উত্তর, রায়গঞ্জ আসনে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা। এই আটটি লোকসভা আসনের মধ্যে ৫৬টি বিধানসভা আসন। তার মধ্যে ৩৭টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি।

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও উত্তরবঙ্গে যথেষ্ট ভাল ফল করেছিল বিজেপি। উত্তরের আট জেলার ৫৪ বিধানসভা আসনের মধ্যে ২৬টিতে জিতেছিল তারা। তৃণমূল জেতে ৩০ আসনে। অর্থাৎ ওই নির্বাচনে উত্তরে কিছু এলাকা ফের দখলে নিতে সমর্থ হয়েছিল তৃণমূল। মালদহ এবং উত্তর দিনাজপুর জেলা থেকে সাতটি করে মোট ১৪টি আসন নিজেদের দখলে রাখে তৃণমূল। কোচবিহারে তৃণমূল পেয়েছিল দু’টি আসন, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়িতে পেয়েছিল একটি করে আসন। আলিপুরদুয়ারে বিজেপি পেয়েছিল চারটি আসন এবং জলপাইগুড়িতে বিজেপি পেয়েছিল ৬টি আসন। দক্ষিণ দিনাজপুরে তিনটি জিতেছিল তৃণমূল। তিনটি বিজেপি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে তৃণমূল কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, দু’দলের ব্যবধান ছিল অল্পই।

Advertisement

এ বারের পঞ্চায়েতে ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, বিজেপি অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে উত্তরবঙ্গে। এমনকি, কোচবিহারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের এলাকা দিনহাটা থেকে রাজবংশী প্রভাবিত অসম সীমানা লাগোয়া এলাকা, সর্বত্রই জয়জয়কার শাসকদলের। এই পঞ্চায়েত ভোটকে লোকসভা ভোটের ‘নেট প্র্যাকটিস’ হিসাবেই দেখেছিল সব পক্ষ। তৃণমূল নেতারা মনে করছেন, এই ফল ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে দলকে চাঙ্গা করবে। যদিও বিজেপি তা মানতে চায়নি। দলের নেতাদের মতে, এ বার যা হয়েছে তা ভোট নয়, শুধুই ‘প্রহসন’।

বিজেপি উত্তরবঙ্গে কেমন প্রত্যাশা করেছিল তার আভাস ছিল ভোটের আগে বিধানসভায় বিজেপির মুখ্যসচেতক তথা মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ টিগ্গার বক্তব্যে। মনোজ বলেছিলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের মানুষ সব সময়েই আমাদের আশীর্বাদ করেছেন। এ বারেও তাই হবে। ফলাফল নিয়ে এখনই নির্দিষ্ট করে কিছু বলছি না। তবে সব জেলাতেই আমরা তিনটি স্তরেই শক্তি বাড়াব।’’ টিগ্গার এই দাবি অবশ্য খারিজ করে দিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা কোচবিহারের দিনহাটার তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা এ বার ২০১৯ তো বটেই, ২০২১ সালের থেকেও ভাল ফল করব! আগে আমাদের কিছু ব্যর্থতা ছিল। বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণ করে সাফল্য পায়। আমরা মোকাবিলা করতে পারিনি। এ বার তা হবে না। রাজ্য ভাগের জিগির তুলেও বিজেপি সুবিধা করতে পারবে না।’’

বিজেপি রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ সুকান্ত মজুমদারের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরে এ বারও সব আসন দখল করেছে তৃণমূল। শুধু তা-ই নয়, তৃণমূলের ইসলামপুরের বিধায়ক করিম চৌধুরী এবং কানাইয়ালাল আগরওয়ালের গোষ্ঠীর সংঘর্ষে বার বার উত্তপ্ত হওয়া জেলা উত্তর দিনাজপুরেও জেলা পরিষদ দখল করল শাসকদলই। গত কয়েক মাস ধরেই দলের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছেন করিম। ‘জনসংযোগ যাত্রা’র মাঝে ইটাহারে অভিষেকের ডাকা বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। সম্প্রতি বিধায়কদের দলের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন বিধানসভায় উপস্থিত হন না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন করিম। ইসলামপুরে দলীয় কোন্দলে এক সিভিক ভলান্টিয়ার খুনের ঘটনায় দলের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন তিনি। আবার ইসলামপুর ব্লকের সভাপতির নাম ঘোষণা হওয়ার পর দল ছাড়ার হুমকিও দিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেছিলেন, এই পরিস্থিতির সুযোগ পাবে বিজেপি। কিন্তু ফলাফল বলছে, ২২২০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১,২১৪টি তৃণমূলের দখলে। বিজেপির দখলে রয়েছে ৩৬০টি। কংগ্রেস পেয়েছে ১৭৬টি, সিপিএম পেয়েছে ৭৬টি।

মনোনয়ন পর্ব থেকেই বার বার সংঘর্ষের অভিযোগ উঠেছে কোচবিহারের দিনহাটায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের গড় বলে পরিচিত সেই কোচবিহারেও তৃণমূলের জয়জয়কার। কোচবিহারে ৩৪টি জেলা পরিষদের মধ্যে ৩২টিতেই জিতেছে তৃণমূল। বাকি দু’টিতে জিতেছে বিজেপি। কোচবিহারে গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা ২,৫০৭। তার মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ১,৮৩৪। বিজেপি পেয়েছে ৬১৫টি। সিপিএম ১১টি, কংগ্রেস ১২টি এবং অন্যান্যরা ৩৪টি পেয়েছে। কোচবিহারে ৩৮৩টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ৩০১টি। বিজেপি পেয়েছে ৮১টি।

জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদও বড় ব্যবধানে জিতছে তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন সংখ্যা ১,৭০১। তার মধ্যে ৯৫৮টি পেয়েছে তৃণমূল। বিজেপি পেয়েছে ৪৪০টি। সিপিএম পেয়েছে ৬২টি এবং কংগ্রেস ১০টি। অন্যান্যরা পেয়েছে ৩৫টি। শিলিগুড়ি লাগোয়া ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির চারটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে তিনটি এ বার দখলে রেখেছে তৃণমূল। বাকি একটিতে জিতেছে বিজেপি। গত পঞ্চায়েত ভোটে এই চারটিই যদিও দখলে ছিল তৃণমূলের। ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির এই চারটি গ্রাম পঞ্চায়েতই শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেবের কাছে বড় ‘চ্যালেঞ্জ’ ছিল। কেননা, এই চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে থাকা শিলিগুড়ি পুরসভার ১৪টি সংযোজিত ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির শিখা চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁকে ২৭ হাজার ভোটে হারতে হয়েছিল। তার মধ্যে ১৪টি ওয়ার্ড থেকে প্রায় ২১,৪০০ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন তিনি। গত পুরভোটে ওই সমস্ত ওয়ার্ড থেকে তৃণমূল ২৯,৪০০ ভোটে এগিয়ে ছিল। তাই এ বার পঞ্চায়েত ভোট ছিল চারটি গ্রাম পঞ্চায়েতের পরীক্ষা। তার ফল বেরোতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে তৃণমূল শিবির।

জনবিন্যাস অনুযায়ী আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির নাগরিকদের মধ্যে একটা বড় অংশ আদিবাসী। কোচবিহারে নাগরিকদের বড় অংশ রাজবংশী। সেই আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলিতেও আধিপত্য বজায় রেখেছে তৃণমূল। দক্ষিণ দিনাজপুরে তপন ব্লকে তিন আদিবাসী মহিলাকে দণ্ডি তৃণমূলে ফেরানো হয় বলে অভিযোগ করেছিল বিজেপি। এই ঘটনায় তৃণমূলের দিকে আঙুল তুলেছিল তারা। তিন আদিবাসী মহিলার মধ্যে এক জন শিউলি মার্ডিকে গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। বিজেপি দাবি করেছিল, ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতেই তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে। ‘জনসংযোগ যাত্রা’-য় গিয়ে শিউলির সঙ্গে দেখা করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও বিজেপির একাংশ মনে করেছিল, শিউলি-কাণ্ডের জেরে আদিবাসী আবেগে আঘাত লাগতে পারে। তাতে আদিবাসী ভোট হারাতে পারে তৃণমূল। সেই শিউলিও জিতে গিয়েছেন।

মালদহ সংখ্যালঘু প্রধান জেলা। এখানে মোট গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা ৩,১৮৬। তার মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৫৯৬টি। গ্রাম পঞ্চায়েত জয়ের নিরিখে তৃণমূলই শীর্ষে। তারা পেয়েছে ১,৫৩১টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কংগ্রেস। তারা মালদহে জিতেছে ৬৯১টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন। মালদহে জেলা পরিষদ আসন রয়েছে ৪৩টি। তার মধ্যে বিজেপির দখলে চার। তৃণমূলের দখলে ৩৩। দুঁদে কংগ্রেস নেতা গনি খান পরিবারের গড় বলে এককালে পরিচিত ছিল মালদহ। সেই জেলায় গনির নিজের দলও ভাল ফল করতে ব্যর্থ। কংগ্রেস পেয়েছে ছ’টি জেলা পরিষদ। মালদহে পঞ্চায়েত সমিতির আসন ৪৩৬টি। সেখানে তৃণমূল পেয়েছে ২৪৩টি আসন। বিজেপি পেয়েছে ৭৯টি এবং কংগ্রেস পেয়েছে ৯১টি আসন।

গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে তৃণমূলের এই জয়ের দাপটকে তাদের ‘ফিরে আসা’ হিসাবে দেখতে চাইছে না বিজেপি। বরং বার বার তারা ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছে। এই প্রসঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘ভোট হলেই তবে জয়-পরাজয়ের বিচার হয়। ভোট নিয়ে প্রহসন হয়েছে। গণনাতেও কারচুপি হয়েছে। অতএব ভোট দেখে কিছু বোঝা যাবে না। আমাদের কর্মীরা কতটা চাঙ্গা, তা দেখতে হবে।’’ ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের প্রসঙ্গ উঠতেই সুকান্ত বললেন, ‘‘ওই ভোট তো এই নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে হবে না। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে হবে। নিরপেক্ষতা থাকবে। দেখুন না কী হয়।’’ এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের মুখপাত্র তথা বিধায়ক তাপস রায় বলেন, ‘‘এই ধরনের অভিযোগ দেখে মনে হচ্ছে, বিরোধীরা আসলে জনাদেশকে মানছেন না। তাঁরা ভোটে প্রার্থী দিয়েছেন। আমরাও দিয়েছিলাম। উভয়ই নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলাম মানুষের কাছে। মানুষ যাঁদের গ্রহণ করেছে, তাঁরাই জয়ী। এ ক্ষেত্রে জনাদেশকে মেনে নেওয়া উচিত।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement