পঞ্চায়েত ভোটের ফল নিয়ে নিশ্চিন্তেই শাসক তৃণমূল। — ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে শনিবার। গণনা মঙ্গলবার। তার মধ্যবর্তী সময়ে শাসক এবং বিরোধী— উভয়েরই নজর উত্তরের দিকে। যে কোনও ভোটের মতোই পঞ্চায়েত ভোটের পরে তৃণমূল, বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস প্রাথমিক খবরাখবরের ভিত্তিতে নিজেদের মতো করে দলের অন্দরে হিসেবনিকেশ করেছে। ব্যালট পেপারে ভোট হওয়ায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে জেলা পরিষদের ফলাফল জানতে জানতে মঙ্গলবার গভীর রাত বা বুধবার সকাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু রবিবার তিন শিবিরের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল— উত্তরবঙ্গের দিকেই মূল নজর।
শাসক তৃণমূল প্রকাশ্যে প্রত্যাশিত ভাবেই বলছে, গত বারের মতো এ বারেও রাজ্যের ২০টি জেলা পরিষদই তাদের দখলে থাকবে। কিন্তু একান্ত আলোচনায় নেতাদের একাংশ স্বীকার করে নিচ্ছেন, উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে চ্যালেঞ্জের সামনে পড়েছে দল। গত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের পঞ্চায়েতেও উত্তরবঙ্গে ‘ধাক্কা’ খাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।
রাজ্যে মোট জেলা পরিষদের আসনসংখ্যা ৯২৮। তবে তৃণমূল আগেই ১৬টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছে। ফলে লড়াই ৯১২ আসনে। পাঁচ বছর আগের হিসাবে এ বার লড়াই বেশি। গত বার মোট ৮২৫ জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল জিতেছিল ২০৩টিতে। ভোটের আগেই বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদের দখল পেয়ে গিয়েছিল তারা। জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ দিনাজপুরে সব আসনে জয় পায় তৃণমূল। বিরোধীশূন্য জয় ছিল দুই মেদিনীপুর, হুগলি, বাঁকুড়া, দুই বর্ধমানে।
তবে এ বার তেমনটা হবে না বলেই মনে করছে তৃণমূল। এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘২০১৮ সালের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। সেটা একটা অন্য পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ভোট হয়েছিল। এ বার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন সবাই লড়াই করুক। হারজিত থাকুক। তবে গত বারের তুলনায় বিরোধীরা কতটা জয় পাবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়।’’
আগামী বছর লোকসভা ভোটের আগে পঞ্চায়েত ভোটে উত্তরবঙ্গের ফলাফলের দিকে নজর রয়েছে তৃণমূলের। বস্তুত, বিরোধী বিজেপিও মনে করছে, তাদের যা হওয়ার উত্তরেই হবে। আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারে জেলা পরিষদ দখলের মতো ‘শক্তি’ দেখানোর পাশাপাশি তারা ‘ভাল’ ফলের আশা করছে জলপাইগুড়ি এবং দুই দিনাজপুরে।
তুল্যমূল্য বিচারে শাসকদলের নেতাদের একাংশ ঘরোয়া আলোচনায় জানাচ্ছেন, উত্তরের দু’টি জেলা আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারে আশানুরূপ ফল না-হওয়ার সম্ভাবনা। রাজ্য স্তরের এক নেতার কথায়, ‘‘দীর্ঘ সময় রাজ্যের ক্ষমতায় থাকায় কিছুটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া তো তৈরি হয়েছেই। সেই সঙ্গে সিবিআই, ইডি লাগিয়ে দলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগকে সামনে আনা হচ্ছে। রাজ্যের সর্বত্র সংগঠন না থাকায় বিজেপি খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। তবে উত্তরবঙ্গে প্রভাব পড়তে পারে।’’
বিজেপিও আশাবাদী শুধু উত্তর নিয়েই। আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং দুই দিনাজপুর ছাড়া মালদহেও ভাল ফলাফলের আশা করছে গেরুয়া শিবির। তবে দু’টির বেশি জেলা পরিষদ দখল করার কথা ভাবছে না গেরুয়া শিবির। উত্তরবঙ্গ থেকে রাজ্য বিজেপির প্রথম সভাপতি সুকান্ত মজুমদার অবশ্য উত্তর-দক্ষিণ আলাদা করতে চাইছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আমি জ্যোতিষী নই। তাই ফল নিয়ে আগাম কিছু বলব না। রাজ্যের সব জায়গাতেই ভোটের নামে কমবেশি প্রহসন হয়েছে। মানুষ যেখানে ভোট দিতে পেরেছেন, আমরা যেখানে সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে পেরেছি সেখানকার ফলই বলে দেবে রাজ্যের মানুষ কী চায়।’’
দক্ষিণবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর নিয়ে বিজেপি আশাবাদী ছিল। কারণ, প্রথমত এটি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলা। দ্বিতীয়ত, ওই জেলার ১৬টি বিধানসভা আসনের বিজেপি সাতটিতে জিতেছিল। কিন্তু ভোটের পর তারা অতটা আশাবাদী নয়। শনিবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু দিনভর নিজের বিধানসভা কেন্দ্র নন্দীগ্রামে ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যপাল এবং কেন্দ্রীয় সরকার ভাবছেন কি না জানি না, এই রাজ্যে ৩৫৬ অথবা নির্বাচনের সময়ে ৩৫৫ জারি করে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ না করতে পারলে পশ্চিমবঙ্গে কোনও ভোট হতে পারে না।’’ যার পাল্টা শাসকদলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘হার নিশ্চিত বুঝতে পেরে গিয়েই এই সব বলছে।’’ রবিবার জেলার নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী অখিল গিরিও আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘বিরোধী দলনেতা নিজের বিধানসভা এলাকার জেলা পরিষদ আসন, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতে জিততে পারবেন না। জেলাতেও সার্বিক ভাবে বিজেপির ফল খারাপ হবে।’’
বিজেপি অবশ্য এখনও কিছুটা আশাবাদী জঙ্গলমহল নিয়ে। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়ার অনেক জায়গায় বুথে এজেন্ট বসাতে পারেনি বলে তৃণমূলই অভিযোগ করেছে। তবে সেটা কুড়মি আন্দোলনের জেরে। বিজেপি মনে করছে, কুড়মিরা সমাজ হিসাবে ভোট দিলেও তা গেরুয়া শিবিরের পক্ষেই যাবে। মতুয়া প্রধান নদিয়াতেও বিজেপি ভাল ফলের আশা করছে। ২০১৮ সালে বিজেপি এই জেলায় দু’টি জেলা পরিষদের আসনে জয় পেয়েছিল। সেই সংখ্যা বাড়বে বলেই গেরুয়া শিবিরের আশা। তবে দুই ২৪ পরগনা এবং হাওড়া, হুগলি নিয়ে তেমন আশায় নেই বিজেপি। জেলা পরিষদে দলের উপস্থিতি থাকা নিয়েই চিন্তা রয়েছে গেরুয়া শিবিরের।
বিধানসভায় বিজেপির মুখ্যসচেতক তথা মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ টিগ্গা বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের মানুষ সব সময়েই আমাদের আশীর্বাদ করেছেন। এ বারেও তাই হবে। ফলাফল নিয়ে এখনই নির্দিষ্ট করে কিছু বলছি না। তবে সব জেলাতেই আমরা তিনটি স্তরেই শক্তি বাড়াব।’’
তবে রাজ্যের মন্ত্রী তথা কোচবিহারের দিনহাটার তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ বলেন, ‘‘আমরা এ বার ২০১৯ তো বটেই, ২০২১ সালের থেকেও ভাল ফল করব! আগে আমাদের কিছু ব্যর্থতা ছিল। বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণ করে সাফল্য পায়। আমরা মোকাবিলা করতে পারিনি। এ বার তা হবে না। রাজ্য ভাগের জিগির তুলেও বিজেপি সুবিধা করতে পারবে না।’’
মুর্শিদাবাদ জেলায় অবশ্য বাম-কংগ্রেস জোটই তৃণমূলের প্রধান ‘প্রতিপক্ষ’ হবে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা। তবে শনিবারের ‘রক্তাক্ত’ ভোটগ্রহণ পর্বের পরে নিরাশার সুর শোনা গিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরির কথায়। নিজের গড় মুর্শিদাবাদ নিয়ে তাঁকে খুব আশাবাদী শোনায়নি। কংগ্রেসের জোটসঙ্গী সিপিএম অবশ্য ফলাফল নিয়ে নীরব। দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম রবিবার একটি বিবৃতি জারি করলেও তাতে শনিবারের অশান্তির কথাই বলেছেন। আক্রমণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে।
প্রসঙ্গত, রাজ্যের মোট ২২টি জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হলেও জেলা পরিষদ স্তরের ভোট হয়েছে ২০টিতে। দার্জিলিং এবং কালিম্পং জেলায় ভোট দু’টি স্তরে। গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি। কারণ, জেলা পরিষদের বদলে পাহাড়ের প্রশাসন সামলায় ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিটিএ)। তার আলাদা ভোট হয়।