দাঁতই সম্পদ বিশ্বজিতের। — নিজস্ব চিত্র।
আগে একটা নারকেল ছুলতে সময় লাগত এক মিনিট। এখন এক মিনিটে পাঁচ থেকে ছ’টা নারকেল ছুলে ফেলেন বিশ্বজিৎ বর্মণ। ছুরি, কাটারি লাগে না। স্রেফ দাঁতের জোরেই একটার পর একটা নারকেল ছুলে ফেলেন। সেই ‘প্রতিভা’র জন্যই বিদেশের প্রতিযোগিতায় ডাক পেয়েছেন। কিন্তু যাওয়ার মতো আর্থিক সংস্থান নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য পাওয়ার আশায় রবিবার সটান চলে গিয়েছিলেন কেন্দ্রের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের কাছে। কোচবিহারের সাংসদের সামনে প্রতিভা দেখাতে গিয়ে ৩০ সেকেন্ডে তিনটি নারকেলও ছুলে ফেলেন। এটাই বছর ২৪-এর যুবক বিশ্বজিতের এখনও পর্যন্ত দ্রুততার রেকর্ড!
আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটার ডালিমপুর গ্রামের কৃষক সুধাংশু বর্মণ। নিজের কিছুটা জমি থাকলেও চাষবাস করেন মূলত অপরের জমিতে। স্ত্রী বিমলা সংসার সামলান। ঘরে অভাব থাকলেও ছেলেমেয়েকে লেখাপ়ড়া শেখানোয় খামতি রাখেননি ওঁরা। মেয়ে সুস্মিতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। ছেলে বিশ্বজিৎ ফালাকাটা কলেজ থেকে সংস্কৃতে নিয়ে স্নাতক। তবে ছোট থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি দাঁতে করে নারকেল ছুলে তাক লাগাতেন বিশ্বজিৎ। এখন সেই প্রদর্শনকেই পেশা করতে চান।
১২-১৩ বছর বয়স থেকেই বাড়িতে নাড়ু হলে দাঁতে করে নারকেল ছুলে ফেলতেন। বিশ্বজিৎ বললেন, ‘‘প্রথম প্রথম এমনিই করতাম। তার পরে মনে হল, এটা অভ্যাস করি। রোজ করতে শুরু করি। এখন অনেকেই জেনে গিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় আমার নারকেল ছোলার প্রদর্শনীও হয়।’’
প্রদর্শনীর শুরু ২০১৯ সালে। ফালাকাটা কলেজের নবীনবরণে এক মিনিটে তিনটি নারকেল ছুলে তাক লাগিয়ে দেন। এর পরে করোনাকালে দু’টি সংস্থার অনলাইন প্রতিযোগিতায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি পেয়ে যান। আসলে দাঁত দিয়ে নারকেল ছোলার কৃতিত্বে প্রতিদ্বন্দ্বীও তেমন নেই। সেই নেশায় বিশ্বজিৎ রোজ নারকেল ছুলে চলেছেন আর নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি করছেন। ইদানীং পুকুরের জলে ডুব দিয়ে, রাস্তায় স্কেটিং করতে করতেও নারকেল ছোলার অনুশীলন করছেন।
প্রদর্শনী থেকে যে খুব একটা রোজগার হয় তা নয়। বিশ্বজিতের বক্তব্য, ‘‘আমি নিজের প্রতিভার প্রচারের জন্যই যাই। তবে কেউ কেউ খুশি হয়ে টাকাও দেন।’’ এখনও পর্যন্ত একটি প্রদর্শনীতে তাঁর সর্বাধিক প্রাপ্তি দু’হাজার টাকা। কিন্তু এ বার বড় সুযোগ এসেছে। সেটি হাতছাড়া করতে চাইছেন না বিশ্বজিৎ। ডালিমপুরের ছেলে ইংল্যান্ডে যাওয়ার ডাক পেয়েছেন। আগামী ১১ নভেম্বর ‘ব্রিটেন গট ট্যালেন্ট’ রিয়্যালিটি শোয়ের ‘অডিশন’। কিন্তু এখনও ভিসা হয়নি। টিকিটের টাকাও জোগাড় হয়নি। সে সব হয়তো বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের থেকে নেওয়া যাবে। কিন্তু ভিসা কী করে করতে হয় সেটাই অজানা বিশ্বজিতের। একটু সময় চেয়ে রিয়্যালিটি শোয়ের কর্তাদের কাছে আবেদন পাঠিয়েছেন। জবাব মেলেনি এখনও। চিন্তায় ‘ডালিমপুরের প্রতিভা’।
কিছুদিন আগেই ফালাকাটার বিজেপি বিধায়ক দীপক বর্মণের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তার পরে মন্ত্রী নিশীথ। বিশ্বজিৎ জানান, মন্ত্রী চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। আর দীপক বলেন, ‘‘সরকারি ভাবে সাহায্য করা যায় কি না জানি না। গেলেও সেটা আমার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি বিশ্বজিতের পাশে রয়েছি। যা যা সাহায্য দরকার করব।’’ একই কথা বলছেন আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বার্লাও। আনন্দবাজার অনলাইনকে বিজেপি সাংসদ বলেন, বিধায়ক দীপকের সঙ্গে কথা বলবেন। তবে নিশীথের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশিথ প্রামাণিককেও নিজের প্রতিভা প্রদর্শন করেছেন বিশ্বজিৎ বর্মণ। — নিজস্ব চিত্র।
আদৌ বিদেশে ওই প্রতিযোগিতায় যাওয়া হবে কি না, তা অনিশ্চিত বলে কিছুটা হতাশারই সুর বিশ্বজিতের গলায়। বললেন, ‘‘আমি তো গাঁয়ের ছেলে। বিদেশে যেতে গেলে কী কী করতে হয় কিছুই জানি না। দেখা যাক, কতটা কী হয়। আমেরিকার একটি প্রতিযোগিতার জন্যও অনলাইনে অডিশন দিয়েছি। আশা করছি, ডাক পাব।’’
বিশ্বজয়ের স্বপ্ন পূরণ হবে কি না সেটা ভেবে মনের জোর মাঝেমাঝেই কমে যায় বিশ্বজিতের। তবে দাঁতের জোর কমার সুযোগটুকু দেন না। জানান, সাধারণ টুথ পেস্ট নয়, দাঁতের জোর বজায় রাখতে নিমের দাঁতনই তাঁর পছন্দের। দাঁতের জোর বাড়াতে নিমের ডাল আর দাঁতের পরীক্ষা নিতে নারকেল তাঁর প্রতিদিনের সঙ্গী।