Birth Control Service

টানা লকডাউনে সমস্যা জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিষেবায়

বেশির ভাগ ওষুধের দোকানে অন্য সব ওষুধের সঙ্গে গর্ভনিরোধকেরও আকাল তৈরি হয়েছিল।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২০ ০৪:০৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

হুঁশিয়ারি ইতিমধ্যে শুনিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ।

Advertisement

‘ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড’ (ইউএনডিপি) সম্প্রতি জানিয়েছে, লকডাউনের কয়েক মাস বিশ্বের মধ্য ও নিম্ন অর্থনীতির দেশগুলির (যার মধ্যে ভারত অন্যতম) প্রায় সাড়ে চার কোটি মহিলা গর্ভনিরোধক ব্যবস্থার সুবিধা পাননি। এই ‘অবাঞ্ছিত’ গর্ভাবস্থার ফলে আগামী ক’মাসে পৃথিবীতে প্রায় ৭০ লাখ শিশু জন্মাবে।

কড়া লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে মার্চের শেষ থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত কলকাতাতেও প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে গর্ভপাত, মহিলা ও পুরুষদের বন্ধ্যত্বকরণ অস্ত্রোপচার, কপার-টি পরানো, গর্ভনিরোধক ইঞ্জেকশন দেওয়া, কন্ডোম ও পিল বিলির মতো কাজ তলানিতে ঠেকেছিল। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত বৈধ গর্ভপাত ক্লিনিক, চিকিৎসকদের প্রাইভেট ক্লিনিকও সেই সময় বন্ধ ছিল। বেশির ভাগ ওষুধের দোকানে অন্য সব ওষুধের সঙ্গে গর্ভনিরোধকেরও আকাল তৈরি হয়েছিল। ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ-পরিষেবা পেতে অসুবিধা হয়েছে মানুষের।

Advertisement

সরকারি ও বেসরকারি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের আশঙ্কা, এ রাজ্যেও বহু ‘অবাঞ্ছিত’ মাতৃত্বের নজির তৈরি হবে এবং অবৈধ জায়গায় গর্ভপাত করাতে গিয়ে অনেকের প্রাণসংশয় হতে পারে।

কোভিড কালে পরিবার-পরিকল্পনা পরিষেবা

সরকারি হাসপাতাল

পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবায় সরকারের সঙ্গে কাজ করা জাতীয় স্তরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার গড়িয়াহাট, বাঁশদ্রোণী, সখেরবাজার, হাতিবাগান এবং বারাসত মিলিয়ে ৫টি ক্লিনিক রয়েছে। ক্লিনিক ম্যানেজার শ্যামলী মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছিলেন, গত ২২ মার্চ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তাঁদের ক্লিনিকগুলি বন্ধ ছিল। খোলার পর থেকে অনবরত ‘কেস’ আসতে শুরু করেছে।

‘ফাউন্ডেশন অব রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ সার্ভিসেস ইন্ডিয়া’র সাম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্ট:

• লকডাউনে দেশের প্রায় আড়াই কোটি দম্পতি জন্মনিরোধক প্রক্রিয়ার সুবিধা নিতে পারেননি।

• ফল হিসেবে আগামী কয়েক মাসে ভারতে প্রায় ১১ লাখ অবাঞ্ছিত প্রসব হওয়ার আশঙ্কা।

• সংস্থার সিইও বি এস চন্দ্রশেখরনের ব্যাখ্যায়, ‘‘এই পরিস্থিতিতে আগামী বছরের শুরুতে ভারতে অতিরিক্ত প্রায় ১৮ লাখ গর্ভপাত হবে, যার ভিতর আনুমানিক ১০ লাখই হবে ‘আনসেফ’ বা ঝুঁকিপূর্ণ।’’

• কলকাতার ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’ এর অধ্যাপক শাশ্বত ঘোষের ব্যাখ্যায়, পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিয়ে ও আঠারো বছরের আগে মা হওয়া মেয়ের সংখ্যা এমনিতেই বেশি। কঠোর লকডাউনের প্রায় তিন মাস প্রয়োজনীয় গর্ভনিরোধক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে রাজ্যে এঁদের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা।

(ফাউন্ডেশনটি দেশে বেসরকারি ক্ষেত্রে ‘ক্লিনিক্যাল ফ্যামিলি প্ল্যানিং সার্ভিস’ দেওয়ার বৃহত্তম সংস্থা)

শ্যামলীর কথায়, কেউ লকডাউনের সময় গর্ভনিরোধক সামগ্রী পাননি বলে অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব বয়ে বেড়াচ্ছেন এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। হাতুড়ের কাছে গর্ভপাত করাতে গিয়ে কারও কারও প্রাণসংশয় হয়েছে। একাধিক মহিলা আবার দোকান থেকে গর্ভপাতের ওষুধ কিনে খেয়েছেন, তার পরেও গর্ভপাত হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভ্রূণের ক্ষতি এবং বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু ২০ সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ায় এখন আর আইনত গর্ভপাত করাও যাবে না।

বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা, ‘‘লকডাউনের তিন মাস ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল ও ইমার্জেন্সি গর্ভপাতের অজস্র ফোন পেয়েছি। ভিডিয়ো কলে সাহায্য করেছি। কিন্তু নিশ্চিত, এর বাইরে এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁরা কারও সাহায্য পাননি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার এক পরিচিত স্থানীয় এক ক্লিনিকে গর্ভপাত করান। অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তাঁর অন্ত্র ফুটো করে দেওয়া হয়। পরে তিনি মারা যান।’’

কলকাতার চারটি জায়গায় পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক চালায় ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’র রাজ্য শাখাও। সংস্থার কলকাতা শাখা প্রবন্ধক সুপ্রতীপ মজুমদার বলেন, ‘‘লকডাউনের সময় অনেকেরই ওরাল পিলের ‘কন্ট্রাসেপ্টিভ সাইকল’ ও রিনিউয়াল মিস হয়েছে। যাঁদের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গর্ভপাত দরকার ছিল, তাঁদের অনেকেই করাতে পারেননি।’’ রাজ্যের আশা কর্মী ইউনিয়নের প্রধান ইসমত আরা খাতুনেরও বক্তব্য, মার্চ থেকে জুনের প্রথম পর্যন্ত জেলা ও ব্লকগুলিতে ওষুধ, কন্ডোম, পিল সরবরাহ অনিয়মিত ছিল। মহিলাদের কপার টি পরানো, গর্ভনিরোধক অন্তরা ইঞ্জেকশন দেওয়া বা বন্ধ্যত্বকরণের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া— কিছুই করা যায়নি। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘ওই সময় শিশুদের রুটিন টিকাকরণ থেকে শুরু করে সব পরিষেবাই কম হয়েছে। তবে আশা কর্মীরা এপ্রিল ৬-এর পর থেকে জেলায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনার কাজ করেছেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘তবে সর্ব স্তরেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, কড়া লকডাউনের তিন মাসের জন্য এই বছরের শেষ থেকে আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে জন্মের হার এক ধাক্কায় বাড়বে। তার চাপ সরকারি হাসপাতালেও আসবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement