৮ দফায় ভোট রাজ্যে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
উদ্যোগ পর্ব
দেশের ৫ রাজ্যে ‘কুরুক্ষেত্র’-এর উদ্যোগ। কিন্তু একযাত্রায় পৃথক ফল পশ্চিমবঙ্গের!
নয়া কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন-সহ নানা ইস্যুতে তেতে থাকা রাজনীতির পারদ আরও খানিকটা চড়িয়ে দিয়ে মার্চের শেষ লগ্নে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, পুদুচেরি, কেরল এবং তামিলনাড়ুর ভোট ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ৫ রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটপর্বই ছিল সর্বাধিক প্রলম্বিত। করোনার মতো অতিমারির দাপটের মধ্যে ৮ পর্বের এমন রাজনৈতিক ‘মহাকাব্য’ রচনা আক্ষরিক অর্থেই ছিল বেনজির।
৮ দফার ভোটের আদি, উপ এবং অন্ত— প্রতি পর্বেই তৈরি হয়েছিল টানটান নাটকীয় উপাদান। যা শাসক এবং বিরোধী, ২ শিবিরের কাছেই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক হাতিয়ার। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন রাজনৈতিক মাইলফলকও। প্রতি দফার ভোটেই বিপুল নিরাপত্তার আয়োজন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ‘ভোট মানেই রক্তপাত’— সমাজজীবনে চালু হয়ে যাওয়া এই ‘প্রবাদ’কে মিথ্যা প্রমাণ করা যায়নি। বরং কোচবিহারের শীতলখুচিতে ৪ ভোটারকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের বিরুদ্ধেই। ভোটের ওই পর্বেই প্রথম বার ভোট দিতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কমিশনের কোপে পড়ে প্রচারে ২৪ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরেও। আবার এ বারের ভোট দেখেছে নিজের পরিচিত ভবানীপুর কেন্দ্রের বাইরে, তৃণমূলের অন্যতম উত্থানভূমি নন্দীগ্রাম থেকে ভোটের লড়াইয়ে মমতাকে অংশ নিতে। ভোটের আগে, নন্দীগ্রামে প্রচারে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। যে ঘটনাকে ঘিরে সরগরম হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি। গোটা ভোট পর্বে হুইল চেয়ারে চড়েই একের পর এক জনসভা করেছেন তৃণমূল নেত্রী। সেইসঙ্গে যোগ দিয়েছেন একাধিক দলীয় কর্মসূচিতেও। যে ছবি গোটা দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিরল। এমনই নানা খণ্ডচিত্র সার্বিক ভাবে তৈরি করেছে এ রাজ্যের ভোট-কোলাজ।
নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজ্যের শাসক এবং বিরোধী যখন একে অপরের বিরুদ্ধে তাল ঠুকতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সুযোগে নিঃশব্দে হানা দিয়েছে করোনা সংক্রমণ। যার প্রবল প্রতাপ রয়ে গিয়েছে ভোট মিটে যাওয়ার পরেও। সংক্রমণের ছোবল থেকে বাদ যাননি রাজনৈতিক কুশীলবরাও। সংক্রমণের শিকার হয়ে প্রার্থীদের মৃত্যু হয়েছে। এমন ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী ইতিপূর্বে কখনও হতে হয়েছে বলে স্মরণ করতে পারছেন না অনেকেই।
নন্দীগ্রাম পর্ব
নির্বাচন নয়, যেন রাজনীতির পরীক্ষাগার জমি আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখা নন্দীগ্রাম!
কেরল, তামিলনাড়ু, অসম এবং পুদুচেরির সঙ্গে ভোট এ রাজ্যেও। কিন্তু প্রচারের আলোর প্রায় পুরোটাই কেড়ে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে গত লোকসভা ভোটে বিজেপি-র উত্থানের পিছনে অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল জঙ্গলমহলের। সেই জঙ্গলমহল দিয়েই যুদ্ধ-পর্বের শুরু হয়েছিল রাজ্যে। সেই সঙ্গে ছিল তৃণমূলের দুর্গ পূর্ব মেদিনীপুরও। তবে শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগদানের পর, পূর্ব মেদিনীপুরের রং কতটা বদলায় তা এখন দেখার। চমক ছিল দ্বিতীয় দফার ভোটেও। কারণ, এই দফাতেই ভোট হয় তৃণমূলের জমি আন্দোলনের ধাত্রীভূমি নন্দীগ্রামে। যেখানে প্রার্থী মমতা নিজে। প্রতিপক্ষ শুভেন্দু। গুরু-শিষ্যের লড়াইয়ের উদাহরণ আগেও দেখেছে ভারতীয় রাজনীতি। কিন্তু এই ভোটে মমতা বনাম শুভেন্দুর যুদ্ধ ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে। শুভেন্দুর বিরুদ্ধে ধর্মীয় মেরুকরণের তাস খেলার অভিযোগ উঠেছে। আবার মমতার বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামে তোষণের অভিযোগ তুলে ময়দানে নেমেছিল বিজেপি। ক্রিয়া-বিক্রিয়ার পর নন্দীগ্রাম কার হাতছানিতে সাড়া দেয়, তা এখন গোটা দেশেরই অন্যতম আলোচনার বিষয়।
হুইল চেয়ারে প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র
শীতলখুচি পর্ব
গণতন্ত্রের উৎসবে লাগল রক্তের দাগ!
অবাধ এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের লক্ষ্যে নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনিতে রাজ্যে ৮ দফায় ভোট। এমনটাই ব্যবস্থা করেছিল কমিশন। যা নিয়ে নিয়মমাফিক প্রশংসার সুর শোনা যাচ্ছিল বিরোধী দলগুলির গলায়। কিন্তু গণতন্ত্রের উৎসবে লাগল রক্তের ছোপ। গত ১০ এপ্রিল চতুর্থ দফায় ভোট ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারের মোট ৪৪টি আসনে। আচমকাই অশান্তি কোচবিহারের শীতলখুচি আসনের জোড়পাটকির ১২৬ নম্বর বুথে। সিআইএসএফ-এর গুলিতে নিহত হন ওই বুথেরই ৪ বাসিন্দা। ওই একই দিনে শীতলখুচিতে দুষ্কৃতীদের গুলিতে প্রথম বার ভোট দিতে গিয়ে খুন হতে হয় এক যুবককে। ২টি ঘটনাকে ঘিরে তীব্র আলোড়ন শুরু হয় রাজ্য রাজনীতিতে। সেই ঢেউ ধাক্কা দেয় গোটা দেশেও। ঘটনার পর দিনই শীতলখুচি সফরের কথা ঘোষণা করেন মমতা। কিন্তু পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় ৭২ ঘন্টা কোচবিহারে সব রাজনৈতিক দলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তার পরেও শীতলখুচি-কাণ্ড রাজ্য রাজনীতিতে গভীর ভাবে দাগ কেটে গিয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ওই ঘটনা বাকি ২ দফার ভোটেও প্রভাব ফেলেছে বলেও মনে করছেন অনেকে।
শীতলখুচি-কাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই নতুন রাজনৈতিক চমক। প্ররোচনামূলক বক্তৃতার অভিযোগে মমতার নির্বাচনী প্রচারে ২৪ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা জারি করে নির্বাচন কমিশন। আর সেই ঘটনাকে ঘিরে ফের সরগরম হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি। শীতলখুচি কাণ্ড নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের প্রচারের উপরেও ২৪ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা জারি করে কমিশন।
শীতলখুচি-কাণ্ড ঘিরে তপ্ত রাজ্য রাজনীতি। ফাইল চিত্র
করোনা পর্ব
রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মাঝেই ধাক্কা দিল করোনা সংক্রমণের চোরাস্রোত।
ভোট ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা। একের পর এক ঢেউয়ের ধাক্কা। তা সামলাতে যখন গোটা রাজ্য ব্যস্ত, তার মধ্যেই সঙ্কটের চোরাস্রোত হয়ে দেখা দিল অতিমারি করোনা। চতুর্থ দফার কিছুটা পর থেকেই রাজ্যে দৈনিক করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সেই ধারা অব্যাহত এখনও। এর মাঝেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় মুর্শিদাবাদ জেলার সামশেরগঞ্জের কংগ্রেস প্রার্থী রেজাউল হক ওরফে মন্টু বিশ্বাসের। করোনায় মারা যান জঙ্গিপুর বিধানসভা কেন্দ্রের আরএসপি প্রার্থী প্রদীপ নন্দী। ভোট হয়ে যাওয়ার পর করোনায় মৃত্যু হয় উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহ বিধানসভার তৃণমূল প্রার্থী কাজল সিংহের। মৃত্যু হয় মালদহের বৈষ্ণবনগর কেন্দ্রের নির্দল প্রার্থী সমীর ঘোষেরও। এ ছাড়াও শাসক, বিরোধী— সব শিবিরেরই একাধিক নেতা এবং প্রার্থী করোনায় আক্রান্ত হন। স্বাভাবিক ভাবেই নির্বাচন পর্ব মেটার আগেই নতুন করে আশঙ্কার কারণ হয়ে ওঠে করোনা।
পাখির চোখ পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে একের পর এক জনসভা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। ফাইল চিত্র
রাজ্যে ৮ দফার ভোটের নানা পর্বে তৈরি হওয়া একের পর এক দৃশ্যপট সম্মিলিত ভাবে কোন দৃশ্যের জন্ম দেয় তা জানা যাবে রবিবার। রবিবারই জানা যাবে, বাংলার ভার তৃতীয় বারের জন্য ‘নিজের মেয়ে’র হাতে, না কি না বইবে ভিন্ন কোনও খাতে?