নবান্নে কি যাবেন জুনিয়র ডাক্তাররা, সিদ্ধান্ত আজ

আলোচনার প্রশ্নে আন্দোলনকারীদের মধ্যে মতভেদ স্পষ্ট। তাঁদের একাংশ মুখ্যমন্ত্রীর মতোই কট্টরপন্থী। তাঁরা এ দিন রাতে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে বলে দেন, তাঁরা নবান্নে যাবেন না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা 

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৯ ০৩:০৫
Share:

আন্দোলন: নিগ্রহের প্রতিবাদে এনআরএস থেকে চিকিৎসকদের মিছিল। শুক্রবার। ছবি: সুমন বল্লভ

মুখ্যমন্ত্রীর অনমনীয় মনোভাব, ‘হুমকি’ এবং ‘দুর্ব্যবহার’-এর জেরে বৃহস্পতিবার বিশ বাঁও জলে পড়েছিল স্বাস্থ্য-সঙ্কটের সমাধানসূত্র। শুক্রবার তা উদ্ধারের চেষ্টায় এগিয়ে এলেন রাজ্যের পাঁচ প্রবীণ চিকিৎসক। এ দিন সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পরে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের আজ, শনিবার বিকেলে নবান্নে আসার অনুরোধ করলেন তাঁরা। সেই ডাকে এখনও সাড়া মেলেনি। আন্দোলনকারীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ সকালে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নবান্নে যাওয়া, না-যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

Advertisement

আলোচনার প্রশ্নে আন্দোলনকারীদের মধ্যে মতভেদ স্পষ্ট। তাঁদের একাংশ মুখ্যমন্ত্রীর মতোই কট্টরপন্থী। তাঁরা এ দিন রাতে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে বলে দেন, তাঁরা নবান্নে যাবেন না। মুখ্যমন্ত্রীকেই আসতে হবে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার এসএসকেএমে তিনি যে ‘হুমকি’ দিয়েছেন, সে জন্য ক্ষমা চেয়ে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এই ইগোর লড়াই অব্যাহত থাকলে আমজনতার চিকিৎসা-ভাগ্যে শনির দশা কাটার আশু সম্ভাবনা নেই!

শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন পাঁচ প্রবীণ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ চৌধুরী, মাখনলাল সাহা, প্লাবন মুখোপাধ্যায় ও অমলেন্দু ঘোষ। পরে সাংবাদিকদের তাঁরা বলেন, এ দিনই আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের নবান্নে এনে মুখ্যমন্ত্রীর মুখোমুখি বসানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। তাঁদের সেই বার্তা নিয়ে এনআরএসে গিয়েছিলেন রাজ্যের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র। কিন্তু আন্দোলনকারীরা রাজি হননি। তখন তাঁদের শনিবার বিকেল পাঁচটায় নবান্নে আসার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রবীণ চিকিৎসকেরা সাংবাদিকদের জানান, তাঁরাও তখন ফের নবান্নে আসবেন এবং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসবে বলেই তাঁরা আশাবাদী।

Advertisement

আন্দোলনকারীদের একাংশ তাঁদের আহ্বান ফেরানোর পরে সুকুমারবাবু বলেন, ‘‘আমি এখনও আমার স্নেহের ছাত্রদের বলছি, তোমরা নবান্নে এসে আলোচনা করো। সমস্যা মিটিয়ে নাও। আর সঙ্কট বাড়িয়ো না। প্রশাসনকেও উদ্যোগী হতে বলছি। আশা করছি, সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।’’

জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ যেমন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণে সাড়া দিতে নারাজ, তেমনই মুখ্যমন্ত্রীও এ দিন সাড়া দেননি রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর ডাকে। রাজভবন সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে এ দিন দুপুরে রাজ্যপালের পক্ষ থেকে ফোন যায় নবান্নে। নবান্ন থেকে জানানো হয়, মুখ্যমন্ত্রী কাঁচরাপাড়া গিয়েছেন। পরে ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস কলকাতা-য় ভর্তি আহত চিকিৎসক পরিবহ মুখোপাধ্যায়কে দেখতে গিয়ে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘আমরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। তিনি এখনও সাড়া দেননি।’’ নবান্ন সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী খুব সম্ভবত রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করবেন না।

বৃহস্পতিবার এসএসকেএমে গিয়ে চার ঘণ্টার মধ্যে কাজ শুরুর ‘হুঁশিয়ারি’ দেওয়ার পাশাপাশি এনআরএসে ‘বহিরাগতের’ উপস্থিতির কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তা নিয়ে অসন্তুষ্ট জুনিয়র ডাক্তার মহল। শনিবার কাঁচরাপাড়ায় নিজের মন্তব্যে অনড় থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এনআরএসে যে ছেলেটি বিবৃতি দিয়েছিল, সে সল্টলেকে চাকরি করে। কোথায় করে? (পাশে বিধাননগরের চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীকে জিজ্ঞেস করে) ক্যালকাটা হার্ট রিসার্চ ক্লিনিকে ১০ বছর ধরে চাকরি করে। তা হলে সে কী ভাবে জুনিয়র ডাক্তার হবে? কোন রাজনৈতিক দল করে, সেটা আর বললাম না। আপনারা বুঝে নেবেন।’’

মুখ্যমন্ত্রীর ‘হুমকি’র পরে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের বহু চিকিৎসক। এ দিন তা কার্যত মহা গণ ইস্তফার রূপ নেয়। বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা একের পর এক ইস্তফা জমা করেছেন। এঁদের মধ্যে অনেক সিনিয়র চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। অনেক জায়গায় আবার এক-একটি বিভাগের সমস্ত চিকিৎসক একযোগে ইস্তফা জমা করেছেন। গত তিন দিন ধরে এই বর্ষীয়ান চিকিৎসকেরাই কোনও মতে সরকারি চিকিৎসা পরিষেবার হাল ধরে ছিলেন। এ বার তাঁরাও সরে দাঁড়ানোয় পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা ভেবে শিউরে উঠছেন সংশ্লিষ্ট সকলেই।

শেষ পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, আরজিকরে ১২৭ জন, এসএসকেএমে ২০০ জন, এনআরএসে ১০৭ জন, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ৫০ জন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ১০০ জন এবং স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ৩৫ জন চিকিৎসক ইস্তফার বয়ানে সই করেছেন। বিবৃতির বয়ান হল, জুনিয়র চিকিৎসকেরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় হাসপাতালে রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিবেশ নেই, তাই তাঁরা পদত্যাগ করছেন।

গণ ইস্তফার ঢেউ লেগেছে জেলাগুলিতেও। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ১১৯ জন চিকিৎসক ইস্তফা দিয়েছেন। মালদহ মেডিক্যালে ৩৬ জন চিকিৎসক অধ্যক্ষের মাধ্যমে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তার কাছে ইস্তফাপত্র পাঠিয়েছেন। আইএমএর জেলা সম্পাদকের কাছে ইস্তফাপত্র জমা দিয়েছেন আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের ৫০ জন চিকিৎসক। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শুক্রবার রাত পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন চিকিৎসক গণ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

প্রশাসনিক দিক থেকে অবশ্য এই সব গণ ইস্তফার কোনও মূল্য নেই। কারণ, সরকারি নিয়ম হল, পদত্যাগ করতে হলে প্রত্যেক চিকিৎসককে ব্যক্তিগত ভাবে তা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠাতে হবে। বস্তুত, এই গণ ইস্তফাকে প্রশাসনের উপরে ‘চাপ’ তৈরির প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, বৃহস্পতিবার এসএসকেএমে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন তার পর পরিস্থিতি জটিল হয়ে গিয়েছে। জুনিয়র চিকিৎসকেরা কাজে যোগ না দিলে হাসপাতাল চালানো যে সম্ভব নয়, সেটা প্রশাসনকে বুঝতে হবে। এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এই আন্দোলনে ইতি টানা জরুরি। প্রশাসনকে বিভিন্ন স্তর থেকে সেই বার্তা দিয়েও লাভ হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে গণ ইস্তফার পথে হাঁটতে হয়েছে।’’ আশির দশকের পরে রাজ্যের চিকিৎসা ক্ষেত্রে কখনও এমন পরিস্থিতি হয়নি বলে জানাচ্ছেন বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

রাজ্যের ১৩টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রায় পুরো পরিষেবাটাই জুনিয়র ডাক্তার নির্ভর। শুক্রবারও অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজেই আউটডোরের দরজা খোলেনি। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে সকাল ১০টা থেকে অবস্থানে বসেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তবে আগের দিন তালা ভেঙে জরুরি বিভাগ খোলা হয়েছে খবর পেয়ে এ দিনও সকাল থেকেই ভিড় বাড়ে রোগীদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি বিভাগের একতলায় পাঁচ জন সিনিয়র চিকিৎসক রোগী দেখতে শুরু করেন। হাসপাতাল সুপার উৎপল দাঁকে সকাল ১০টা থেকে ঘণ্টা দুয়েক জরুরি বিভাগে চিকিৎসা ও ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের খোঁজখবর নিতে দেখা যায়। বিকেলে বৈঠকে একাধিক বিভাগীয় প্রধান অবশ্য দাবি করেন, এ ভাবে বেশি দিন চালানো সম্ভব নয়।

বাঁকুড়া মেডিক্যালে জেলার দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা চিকিৎসা না-পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মেদিনীপুর মেডিক্যালে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের পরিজনেদের একাংশের নালিশ, ঠিকঠাক চিকিৎসা হয়নি বলেই এই মৃত্যু। কলেজের অধ্যক্ষ পঞ্চানন কুণ্ডু বলেন, ‘‘কোনও অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখা হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement