(বাঁ দিক থেকে ডান দিকে) গোলাম মুরশিদ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, এবং পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার। ফাইল চিত্র।
ইউটিউব বা চ্যাটজিপিটি-র যুগেও তাঁর গান যে সর্বত্রগামী, তা নিয়ে এতটুকু সংশয়ের অবকাশ নেই। তাঁর গান নিয়ে ব্যাখ্যাও তাই বহুতর। আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে সে ‘পান্থজনের সখা’, সুধীর চক্রবর্তীর কাছে ‘নির্জন এককের গান’, শঙ্খ ঘোষের কাছে ‘এ আমির আবরণ’ ভেঙে আমি থেকে তুমিতে স্বচ্ছন্দ গতায়াত, রণজিৎ গুহের কাছে নিউরালজিয়ার ব্যথা-বেদনা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার, আমি আর মহা-আমির গীতিমাল্য। রবীন্দ্রনাথের গান আজও বাঙালির আশ্রয়, অবশ্যই! এবং সেই আশ্রয়কে অবলম্বন করেই বাঙালি জানে, একটি গানের ভূগোল-ইতিহাস-সঞ্চারী-আভোগের একটি মাত্র ব্যাখ্যাই সব নয়। থাকে বহু ব্যাখ্যান, বহু তত্ত্ব।
কিন্তু তথ্য? হাতের কাছে যদি গীতবিতান, সুরবিতানের পাশাপাশি থাকে এমন কোনও তথ্যভান্ডার, যা জানিয়ে দেবে কোন গান কোন সময়ে লেখা, কবে কোন অনুষ্ঠানে সেটা প্রথম গাওয়া হয়! প্রশান্তকুমার পাল বা সুভাষ চৌধুরীদের অবর্তমানে নতুন যুগকে যা এক লহমায় জানিয়ে দেবে, তাঁর ১৯১২টি গানের মধ্যে ৮৮৩টির
জন্মস্থান জানা যায় না। আবার গান থেকে পরিবর্তিত ২২টি কবিতা ‘সানাই’ কাব্যগ্রন্থে সঙ্কলিত। তাই চক্ষু-বিশেষজ্ঞ পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের চওড়া, ডবল ডিমাই সাইজের ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’ এ বার নব কলেবরে ১৪২৯ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারের অন্যতম বাছাই।
রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি এই তালিকায় উঠে এসেছেন বাঙালির আর এক উজ্জ্বল উদ্ধার কাজী নজরুল ইসলামও। দুই বাংলায় এখন নজরুলকে নিয়ে হরেক কাজ। তারই মধ্যে বিচারকদের নজর কেড়ে নিয়েছে লন্ডনপ্রবাসী গোলাম মুরশিদের নজরুল-জীবনী ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’। সেই গোলাম মুরশিদ, যিনি একদা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে ‘আশার ছলনে ভুলি’ লিখে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন দুই বাংলার হৃদয়। আশি বছর পেরিয়ে তিনিই এই পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় প্রবীণতম। কিন্তু শারীরিক বয়স দমাতে পারেনি তাঁকে।
মানুষ হিসেবে নজরুলের এই পুনর্মূল্যায়ন জরুরি ছিল। তিনি শুধু বিশেষণ মাফিক ‘বিদ্রোহী কবি’, ‘সাম্যবাদী কবি’, ‘মুসলমান কবি’ ছিলেন না। মুসলমান এবং হিন্দু সকলের হাতে সমান ভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন তিনি। ১৯২৮ সালে গ্রামোফোনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। শেষ কবিতার বই ১৯৩০ সালে, তার পর আর লেখেননি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পাশাপাশি ঢাকা, কলকাতা, লন্ডনকেও যেন এক সুতোয় গেঁথে দিল এই আনন্দ-বাছাই।
বিচারতালিকায় আছেন প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। ‘এতদিন হাঁটাচলা করে বহু ব্যবহারে তার পা দুটি কি ক্লান্ত হয়ে গেছে এবার কি ওরা থামতে চাইছে পদচিহ্নগুলিতে যে উত্তরাধিকার বয়ে যাচ্ছে’, এই রকম যতিচিহ্নহীন গদ্যের নির্ভার কবিতা নিয়েই ৫৩ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙা পথের রাঙা ধূলায়’ দিয়ে তিনি জিতে নিয়েছেন বিচারকদের মন।
কোভিড-পর্ব পেরিয়ে এই তালিকা এ বার চতুর্ভুজ। চতুর্থ বাহুতে আছেন তরুণ স্নায়ুবিশেষজ্ঞ সুব্রত চট্টোপাধ্যায়। হেয়ার স্কুল, মেডিক্যাল কলেজ ও আমেরিকায় শিক্ষাশেষে তাঁর নতুন বই ‘চেতনা: বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শনের আলোকে’ আর এক প্রতিদ্বন্দ্বী। চেতনা মানে কী? শুধু জীবিত প্রাণীরই চেতনা থাকে? তা হলে কোমায় কেন মানুষ অসাড় থাকে? নিদ্রা আর চিরনিদ্রার তফাত কী? ধ্যানসমাধিতেই বা কী হয়? দর্শন, শারীরবিজ্ঞান ঘেঁটে এই জাতীয় নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তিনি। বস্তুত, ২০১৯ সালে এই বই বেরোনোর পর পরই দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী তাঁর এক নিবন্ধে এই লেখককে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, ‘কান্ট বলেছিলেন, জগতে দুটি জিনিসের সামনে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। একটি মাথার ওপরে নক্ষত্রখচিত মহাকাশ, অন্যটি নিজেরই ভেতরে শুনতে পাওয়া সৎ-অসৎ বিবেকের কণ্ঠস্বর। সুব্রত যেন ঠিক এই দুটিকেই পাশাপাশি রেখে দিয়েছেন।’
পুরস্কার দৌড়ে এই চারটি বইয়েরই প্রথম প্রকাশ ২০১৯ সালে। কিন্তু তার থেকেও বড় কাকতালীয় মিল অন্যত্র। সুব্রত ও পূর্ণেন্দু দুই ডাক্তারেরই বইয়ের কথামুখ লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ। সৌমিত্রের বইও শঙ্খবাবুকেই উৎসর্গীকৃত। মনে পড়ে, ওটাই ছিল শেষ স্বাভাবিক বছর। তার পরই শুরু হবে মারণ ভাইরাসের আক্রমণ, লকডাউন, অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। সৌমিত্র থেকে শঙ্খ ঘোষ সকলেই বিদায় নেবেন। আনন্দ পুরস্কারও সাময়িক ভাবে স্থগিত রয়ে যাবে।
তবু জীবন থেমে থাকে না। পৃথিবী জানে, আনন্দই শেষ কথা। আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে!