শাহজাহান শেখকে কেন্দ্র করে সন্দেশখালিতে এক মাসে দুই ছবি। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
৫ জানুয়ারি সাতসকাল। ইডিকে দৌড় করিয়ে মারধর করেছিল শাহজাহান শেখের বাহিনী।
৭ ফেব্রুয়ারি মাঝদুপুর। সেই শাহজাহানের বাহিনীকে শুধু দৌড় নয়, লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করিয়েছিল সন্দেশখালির সাধারণ মানুষ।
৮ ফেব্রুয়ারি দিনভর। সেই সন্দেশখালি দফায় দফায় উত্তপ্ত রইল। বিড়ম্বনায় পড়তে হল পুলিশকে। শাহজাহানের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সামনে এসে দাঁড়ালেন অগণিত মহিলা। হাতে বাঁশ, লাঠি, হাতা, খুন্তি। এক মাস তিন দিনের ব্যবধানে সন্দেশখালির দু’রকম ছবি দেখল বাংলা।
বৃহস্পতিবার দিনভর উত্তপ্ত থেকেছে সন্দেশখালি। বিতর্কের কেন্দ্রে এলাকার তৃণমূল নেতা শাহজাহান। রেশন ‘দুর্নীতি’কাণ্ডে যাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল ইডি। প্রথম বার সেখানে ইডিকে মার খেতে হয়েছিল। তার পর আরও এক দিন গিয়ে শাহজাহানের বাড়িতে তালা ভেঙে তল্লাশি চালিয়েছে এসেছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা। বৃহস্পতিবার সেই সন্দেশখালিই দেখল জনরোষ। তবে শাহজাহানের পক্ষে নয়, তাঁর বিরুদ্ধে।
সন্দেশখালির বহু মহিলা বৃহস্পতিবার লাঠি, বাঁশ হাতে পথে নেমেছিলেন। তাঁরা থানা ঘেরাও করেন। দাবি একটাই, শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে হবে। ব্লক সভাপতি শিবপ্রসাদ হাজরা এবং তাঁর সঙ্গী উত্তম সর্দারকেও গ্রেফতারির দাবি তোলেন তাঁরা। জানান, তাঁরাও তৃণমূল করেন। কিন্তু দলের নাম ভাঙিয়ে শাহজাহানেরা গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার করেছেন বলে অভিযোগ ওই মহিলাদের। তাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এ বার শাহজাহান, শিবুদের গ্রেফতারি চান সকলে।
জমি দখল থেকে শুরু করে মিথ্যা অভিযোগ এনে গ্রামবাসীদের হেনস্থা, শাহজাহানদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ বিক্ষোভরত মহিলাদের। দাবি, উত্তম এবং শিবুর লোকজন নিজেদের পোল্ট্রি ফার্মে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। তার পর ভাঙচুর ও আগুন লাগানোর দায় ঠেলেন গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে। এ বার এই সমস্ত অত্যাচারের বিহিত চেয়ে পথে নেমেছেন মহিলারা।
বিক্ষোভকারীদের আরও অভিযোগ, শাহজাহান কোথায় লুকিয়ে আছেন, পুলিশ তা জানে। চার-পাঁচ দিন আগেও নাকি তাঁকে এলাকায় দেখা গিয়েছিল। পুলিশই তাঁকে নিরাপত্তা দিচ্ছে বলে দাবি।
এর আগে বুধবারও সন্দেশখালিতে তৃণমূলের বাহিনীকে পিছু হঠতে হয়েছিল। সন্দেশখালি-২ ব্লকের ত্রিমোহিনী থেকে কাহারপাড়া, দাসপাড়া, পাত্রপাড়া-সহ একাধিক গ্রামে ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’র প্রতিবাদে মিছিল বার করেছিল শাসকদল। সেই সময়ে পাল্টা মিছিল করেন গ্রামবাসীদের একাংশ। দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়ে এলাকা ছাড়তে হয় তৃণমূলকে। কয়েক জনকে নদীতে ঝাঁপ দিতেও দেখা যায়। তার পরের দিনই শাহজাহান-বিরোধী ক্ষোভে ফুঁসে উঠল সন্দেশখালি।
দিনভর বিক্ষোভ
সন্দেশখালিতে শাহজাহানের গ্রেফতারি চেয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীদের একাংশ। বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন মূলত মহিলারা। বাঁশ, লাঠি, হাতা, খুন্তি নিয়ে পথে নেমেছিলেন তাঁরা। জানান, এলাকায় শাহজাহানদের অত্যাচারের বিহিত চান তাঁরা।
বিক্ষোভের মুখে আরও দুই
শাহজাহান ছাড়াও আরও দু’জনের গ্রেফতারির দাবি জানান সন্দেশখালির বিক্ষোভরত মহিলারা। ব্লক সভাপতি শিবপ্রসাদ এবং তাঁর সঙ্গী উত্তমকে গ্রেফতার করতে হবে বলে পুলিশের কাছে জানান তাঁরা। ঘেরাও করা হয় থানাও।
তৃণমূল বনাম তৃণমূল!
সন্দেশখালিতে শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী মহিলারা নিজেদের তৃণমূলের কর্মী বলেই দাবি করেছেন। অর্থাৎ, শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে সন্দেশখালি থেকেও। দলেরই নেতার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন কর্মীরা।
কী অভিযোগ
শাহজাহান এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, শাসকদলের নাম ভাঙিয়ে তাঁরা গ্রামে অত্যাচার চালাচ্ছেন। দখল করে নিচ্ছেন জমি। চাষের জমি, ছোটদের খেলার মাঠ দখল করে, রাস্তা বন্ধ করে তৈরি করা হচ্ছে মাছের ভেড়ি। বিক্ষোভকারী মহিলাদের অভিযোগ, উত্তম এবং শিবুর লোকজন নিজেদের পোল্ট্রি ফার্মে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। তার পর ভাঙচুর এবং আগুন লাগানোর দায় ঠেলেন গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করলেই চলে অকথ্য অত্যাচার। এমনকি, বহিরাগত দুষ্কৃতীদেরও নাকি গ্রামে লেলিয়ে দিয়েছেন শাহজাহানেরা।
বাঘ না বিড়াল!
বাঘ হয়ে বিড়ালের মতো লুকিয়ে আছেন শাহজাহান! বৃহস্পতিবার এমনটাই দাবি করেছেন সন্দেশখালিতে বিক্ষোভরত এক মহিলা গ্রামবাসী। তিনি বলেন, ‘‘শাহজাহানদের গ্রেফতার করতে হবে। না হলে আমরা যাব না।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘শাহজাহান কোথায় আপনি জানেন?’ তার জবাবে ওই মহিলা বলেন, ‘‘শাহজাহান বাঘ হয়ে বিড়ালের মতো লুকিয়ে আছে!’’
‘পুলিশ সব জানে’
শাহজাহান কোথায় আছেন, পুলিশ তা জানে, অভিযোগ গ্রামবাসীদের একাংশের। তাঁরা জানিয়েছেন, পুলিশই নিরাপত্তা দিয়ে শাহজাহানকে লুকিয়ে রেখেছে। এলাকায় চার-পাঁচ দিন আগে ‘নিখোঁজ’ নেতাকে দেখাও গিয়েছে বলে দাবি করেন বিক্ষোভকারীরা।
বুধবার কী হয়েছিল
বুধবারও সন্দেশখালিতে তৃণমূলবাহিনীকে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। বাইক মিছিলের কর্মসূচি ছিল তাদের। সন্দেশখালি-২ ব্লকের ত্রিমোহিনী থেকে কাহারপাড়া, দাসপাড়া, পাত্রপাড়া-সহ একাধিক গ্রামে ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’র প্রতিবাদে মিছিল হচ্ছিল। সেই সময়েই পাল্টা মিছিল করেন গ্রামবাসীদের একাংশ। গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়ে তৃণমূলের কর্মীদের পালিয়ে যেতে হয়। কয়েক জনকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালাতেও দেখা গিয়েছে।
ইডি বনাম শাহজাহান
গত ৫ জানুয়ারি শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল ইডি। সে দিন শাহজাহানের অনুগামীদের হাতে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে মার খেতে হয়েছিল। পরে এক দিন গিয়ে তালা ভেঙে শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালায় ইডি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই মেলেনি।
‘নিখোঁজ’ শাহজাহান
ইডি হানার পর থেকেই শাহজাহান ‘নিখোঁজ’। ইডি এবং পুলিশ তাঁকে খুঁজছে। ইতিমধ্যে ইডি দু’বার তাঁকে তলব করেছে। হাজিরা এড়িয়েছেন সন্দেশখালির নেতা। দ্বিতীয় তলবের দিন তাঁর আইনজীবী একটি চিঠি নিয়ে নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা পরে ইডি দফতরে গিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সংস্থা সেই চিঠি জমা নেয়নি। ইতিমধ্যে শাহজাহান আগাম জামিনের আবেদন জানিয়ে একাধিক বার আদালতের দ্বারস্থও হয়েছেন।