প্রতীকী ছবি।
কেউ বিছানার তোশক মাটিতে বিছিয়ে একা একাই অনুশীলন করছেন। কেউ কেউ আবার ম্যানিকুইন (পুতুল)-এর সঙ্গেই লড়াই করছেন। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে এটাই এখন রোজনামচা বাংলার কুস্তিগিরদের। কারণ, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কুস্তি অন্তত সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে প্রবল আর্থিক সঙ্কট ও মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন বাংলার পালোয়ানেরা।
পশ্চিম বর্ধমানের ছত্রিশগণ্ডা গ্রামের শ্যামসুন্দর পাসি এই মুহূর্তে বাংলার অন্যতম প্রতিশ্রুতিমান কুস্তিগির। ৬০ কেজি বিভাগে রাজ্যের সেরা শ্যামসুন্দর বলছিলেন, ‘‘জানি না কী হবে? সকালে দৌড়চ্ছি। বিকেলে বাড়ির উঠোনে গদি বিছিয়েই অনুশীলন করছি। তাতে খুব একটা উপকৃত হচ্ছি না। কুস্তির অনুশীলনটাও করতে হয় অন্যের সঙ্গে লড়াই করে। কারণ, কুস্তির সাফল্য পুরোটাই নির্ভর করে নানা ধরনের প্যাঁচের উপরে।’’
শুধু অনুশীলন নয়, প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারও জুটছে না শ্যামসুন্দরের। প্রতিশ্রুতিমান কুস্তিগিরের বাবা জামুড়িয়ায় একটি ছোট কারখানায় কাজ করেন। তাঁর একার রোজগারে প্রত্যেক দিন কুস্তিগির ছেলের জন্য দুধ, ঘি, বাদাম, ফল জোগার করা সম্ভব নয়। হতাশ শ্যামসুন্দর বলছিলেন, ‘‘দিনে অন্তত দু’লিটার দুধ খাওয়া দরকার। এর সঙ্গে ঘি, বাদাম, ফল তো রয়েইছে। সব মিলিয়ে মাসে খরচ প্রায় দশ হাজার টাকা। এখন যা পরিস্থিতি তাতে দুধ ছাড়া অন্য কিছু কেনার সামর্থ নেই।’’
আরও পড়ুন: উপযুক্ত তথ্যের অভাবে তদন্ত বন্ধ করল শ্রীলঙ্কা
ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি অসিত সাহা বলছিলেন, ‘‘পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতির এ বার শতবর্ষ। তাই চলতি বছরের এপ্রিলে কলকাতায় জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ছিল। দেশের সেরা কুস্তিগিরেরা অংশ নিতেন। আমাদের প্রস্তুতিও শেষ পর্যায়ে চলছিল। তখনই লকডাউন শুরু হয়।’’ হতাশ অসিতবাবু যোগ করলেন, ‘‘কুস্তিতে শারীরিক সংস্পর্শ হবেই। তাই কোনও ঝুঁকি নিতে পারছি না। গোটা বিশ্বেই এখন বন্ধ রয়েছে কুস্তির অনুশীলন ও প্রতিযোগিতা। আমরা অনলাইনে ওদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। পুষ্টিকর খাবারও পাচ্ছে না সকলে। এই পরিস্থিতিতে ওরা মানসিক অবসাদে ভুগছে।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘জাতীয় পর্যায়ে কুস্তি করেও আমাদের রাজ্যের ছেলে-মেয়েরা চাকরি পায় না। অর্থ উপার্জনের জন্য কেউ কেউ কেটারিংয়ের কাজ করে। করোনার জেরে তাও এখন বন্ধ। এর মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব ওদের পাশে দাঁড়ানোর। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়।’’
শ্যামসুন্দরের পক্ষে অনলাইনে কোচিং নেওয়াও সম্ভব নয়। বললেন, ‘‘আমার তো স্মার্ট ফোন নেই। তাই ক্লাস করতে পারছি না। স্যররা ফোনে যা বলছেন, তা শুনেই অনুশীলন করছি। সব চেয়ে বড় সমস্যা হল, ভুল করলেও কেউ ধরিয়ে দেওয়ার নেই।’’
বাংলার আর এক প্রতিশ্রুতিমান জলপাইগুড়ির গজলডোবার আশিস শীল কুস্তির পাশাপাশি কোচিংও করান। এই জুলাইয়েই বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। সদ্য এনআইএস কোচিং ডিগ্রি পাওয়া আশিস ফোনে বলছিলেন, ‘‘মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। আমাদের ক্লাবে আন্তর্জাতিক মানের ম্যাট রয়েছে। কিন্তু একা একা কি কুস্তি হয়?’’ আশিসও চাকরি পাননি। স্থানীয় বাজারে সব্জি বিক্রি করে কোনও মতে দিন কাটানো কুস্তিগির বললেন, ‘‘আমাদের অনেকেরই ওজন বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, ঠিক মতো অনুশীলনই করতে পারছি না। এ ভাবে বেশি দিন চললে আমরা হয়তো মানসিক রোগী হয়ে যাব।’’
পানিহাটির ১৩ বছরের ঐশানীকে এই মুহূর্তে বাংলার অন্যতম সেরা প্রতিশ্রুতিমান কুস্তিগির মনে করা হচ্ছে। শ্যামসুন্দরের মতোই অবস্থা তার। বাবা গাড়ি চালান। কিন্তু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। মেয়েকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবারও দিতে পারছেন না। আর অনুশীলন তো সেই মার্চ মাস থেকেই বন্ধ। ঐশানীর মা বলছিলেন, ‘‘বাড়ির ছাদেই মূলত অনুশীলন করছে ও। মাঝেমধ্যে বাড়ির সামনের মাঠে দৌড়চ্ছে। করোনার ভয়ে ওকে বেশি বাইরে বেরোতে দিচ্ছি না।’’
গোবর গোহ, নন্দলাল সাহা, নির্মল বসু, নিরঞ্জন দাস, শ্যামসুন্দর চট্টোপাধ্যায়, যোগেশ্বর সিংহ, সুধীর চন্দ্র, যদুনন্দন সিংহ, ছেদিলাল আহির, বনমালী ঘোষদের মতো কিংবদন্তি কুস্তিগিরদের বাংলায় এখন শুধুই অন্ধকার।