অর্জুন পুরস্কার হাতে ঐহিকা মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
তিনি তখন মধ্যমণি। কয়েক দিন আগেই বিশ্বের এক নম্বর টেবল টেনিস তারকা চিনের সান ইয়েংসাকে হারিয়েছেন ঐহিকা মুখোপাধ্যায়। তারও কয়েক দিন আগে পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার। অ্যাকাডেমির কৃতি ছাত্রীকে সংবর্ধনা দিলেন ভারতের দুই প্রাক্তন তারকা সৌম্যদীপ রায় ও পৌলমী ঘটক। ধানুকা ধুনসেরি সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমিতে দাঁড়িয়ে ঐহিকা জানালেন, সানের বিরুদ্ধে খেলার সময় তাঁর মাথায় ঘুরছিল এশিয়ান গেমসের ব্রোঞ্জ পদক জেতার কথা। সেই ম্যাচেও চিনের বিশ্বসেরাদের হারিয়েছিলেন তিনি ও সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়। সেই মন্ত্র নিয়েই সানকে হারিয়েছেন তিনি। ঐহিকা যখন এ কথা বলছেন তখন তাঁর পাশে বসে সুতীর্থা।
বিশ্ব ক্রমতালিকায় ১৫০-র পরে থাকা ঐহিকার কি একটুও ভয় লেগেছিল সানের বিরুদ্ধে খেলতে? না, ভয় পাননি তিনি। বরং তিনি নিজেই সানের বিরুদ্ধে খেলতে চেয়েছিলেন। ঐহিকা বললেন, “আমি আমার দলকে বলেছিলাম, সানের বিরুদ্ধে খেলতে চাই। ওরা তাই ও ভাবেই সাজিয়েছিল যাতে সানের বিরুদ্ধে আমি নামি। ওর বিরুদ্ধে খেলতে নেমে এক বারও ভয় পাইনি। কারণ, বিশ্বসেরা হলেও আসলে তো ও মানুষই। ওরও দুটো হাত আছে। আমারও আছে। আমার মাথায় তখন এশিয়ান গেমসের ম্যাচটার কথা মনে পড়ছিল। ওখানে তো আমরা জিতেছিলাম। ওরাও তো বিশ্বসেরা ছিল। তা হলে সানকে কেন হারাতে পারব না? প্রথম থেকেই জেতার মানসিকতা নিয়ে নেমেছিলাম। লড়াই করেছি। পিছিয়ে পড়েও ফিরেছি। শেষ পর্যন্ত জিতেছি।”
ঐহিকার (ডান দিকে) সংবর্ধনা মঞ্চে পাশে সুতীর্থা। — নিজস্ব চিত্র
চিনের বিরুদ্ধে ঐহিকা ও শ্রীজা আকুলা জিতলেও দলগত বিভাগে ২-৩ হেরেছিল ভারত। তাই জিতলেও কোথাও একটা খচখচ করছে ঐহিকার। আগামী দিনে তিনি চান, পদক জিতে ফিরতে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাউন্ডে হারের ঊর্ধ্বে উঠতে। সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন নৈহাটির মেয়ে। তিনি বলেন, “আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে। চার-পাঁচ বছর আগেও আমরা ভাবতে পারতাম না এতটা এগোতে পারব। প্রথম ধাপ পেরিয়েছি। এ বার পরের ধাপ। এ বার প্রতিযোগিতায় নেমে জিতে ফিরতে চাই।”
এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জেতার পরে অর্জুন পুরস্কার জিতেছেন ঐহিকা। সুতীর্থা পাননি। তাতে অবশ্য তাঁদের বন্ধুত্বে কোনও সমস্যা হয়নি। ঐহিকার পাশে সারা ক্ষণ হাসিমুখে দেখা গেল সুতীর্থাকে। একসঙ্গে নিজস্বী তুললেন। খেলেনও। গল্প করলেন। আবার কবে একসঙ্গে নামছেন দু’জনে। তারও জবাব দিয়ে দিলেন ঐহিকা। ১২ দিন পরেই আবার তাঁদের দেখা যাবে। ৭ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে সিঙ্গাপুর স্ম্যাশ। সেখানে জুটি বেঁধে খেলবেন তাঁরা। তার পরেও বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতা আছে। সেখানে তাঁদের দেখা যেতে পারে। এমনটাই জানালেন ঐহিকার অন্যতম কোচ পৌলমী।
তবে সবটাই কি এতটা সহজ ছিল? কঠিন সময় কি আসেনি? এসেছিল। মনে হয়েছিল খেলাটাই ছেড়ে দেবেন। সেখান থেকে ফিরেছেন ঐহিকা। বাঙালি তারকা বলেন, “২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে কোমরে মারাত্মক চোট পেয়েছিলাম। চিকিৎসকেরা বলেছিল, ২-৩ মাস বিশ্রাম করতে হবে। ভাবতে পারিনি আবার খেলতে পারব। আমার অফিসের (রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক চাকরি করেন ঐহিকা) সহকর্মীরা জোর করে আমাকে খেলতে পাঠায়। ধীরে ধীরে আবার খেলায় ফিরেছি।”
অলিম্পিক্সের ইতিহাসে প্রথম বার দলগত বিভাগে টেবল টেনিসে সুযোগ পেয়েছে ভারতের পুরুষ ও মহিলাদের দল। এখনও সরকারি ঘোষণা না হলেও হিসাব বলছে ২০২৪ সালে প্যারিসে খেলতে দেখা যাবে ভারতীয় দলকে। কিন্তু এখনও ঐহিকার খেলা নিশ্চিত নয়। কারণ, কোন কোন খেলোয়াড়কে পাঠানো হবে তা জাতীয় র্যাঙ্কিংয়ের উপর নির্ভর করবে। সেই কারণে এখনই অলিম্পিক্স নিয়ে ভাবতে নারাজ ঐহিকা। তিনি বলেন, “এখনও জানি না অলিম্পিক্সের দলে খেলার সুযোগ পাব কিনা। পেলে তো ভালই লাগবে। তাই এখন ও সব নিয়ে ভাবছি না। নিজের কাজটা করছি। নিজেকে তৈরি করছি। যেখানেই খেলতে নামব নিজের সেরাটা দিতে চাই।”
মাত্র ২৬ বছর বয়সেই এত কিছু করেছেন ঐহিকা। কেরিয়ারে কতটা পথ পেরোনো হল তাঁর? ঐহিকার মতে, একটুও নয়। তিনি বললেন, “একটা প্রতিযোগিতা শেষ করার পরে যখন আর একটা প্রতিযোগিতায় নামি তখন আবার নতুন করে শুরু হয়। এই পথ চলা শেষ হবে না।’’ এটাই কি ঐহিকার সেরা সময়? নৈহাটির মেয়ে জানিয়ে দিলেন, “সেরা সময় এখনও আসা বাকি। হয়তো এই বছরই আসবে।” অলিম্পিক্সের কথা না ভাবলেও সেই ইঙ্গিতই কি দিয়ে রাখলেন তিনি?