মেসিকে পিছিয়ে দেওয়া থেকে এএফএসি এশিয়ান কাপ খেলা, সুনীলকে নিয়ে দুই মেরুতে ওঁর বাবা-শ্বশুর।
ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের সামরিক বাহিনীতে চাকরি করা বাবা খড়গ ছেত্রীর রোজগার তেমন ছিল না। তাই ব্যাট হাতে নেওয়ার স্বপ্নকে ছোটবেলাতেই জলাঞ্জলি দিয়ে পায়ে তুলে নেন ফুটবল। ভাগ্যিস সেটা করেছিলেন। না হলে ১১৭টি ম্যাচে ৭৪টি গোল করে লিওনেল মেসিকে টপকাতেন কী ভাবে! একমাত্র ছেলের এমন সাফল্যে স্বভাবতই খুশি তাঁর বাবা।
আর ফুটবলকে বেছে নেওয়ার জন্যই তো মাত্র ১৮ বছর বয়সে তাঁকে মোহনবাগানে নিয়ে এসেছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য। সবুজ-মেরুনের তৎকালীন প্রশিক্ষক তার কয়েক বছর পরে ভারত অধিনায়কের শ্বশুর মশাই হয়েছেন। জামাইয়ের বিশ্বজোড়া সাফল্যে উল্লসিত বাগানের প্রাক্তন ডিফেন্ডার।
তবে খুশি হলেও সুনীলের সাফল্যের গুরুত্ব নিয়ে বাবা ও শ্বশুর কিন্তু দুই মেরুতে। আনন্দবাজার ডিজিটালকে শ্বশুর সুব্রত বললেন, “সুনীলের হয়ে ওর রেকর্ড কথা বলছে। যারা বিশ্বকাপ খেলে তাদের জন্য এক নিয়ম, আর যে দেশ এখনও বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি তাদের জন্য অন্য নিয়মের কথা তো ফিফা বলেনি। তাহলে সুনীলের এই রেকর্ড নিয়ে আপত্তি কেন করা হচ্ছে! দিনের শেষে সুনীল তো আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করছে। তাই ওর এই কৃতিত্বকে মোটেও খাটো করে দেখা উচিত নয়। সুনীল আমাদের দেশের গর্ব।”
সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে চাপিয়ে তৎকালীন প্রশিক্ষক সুব্রত ভট্টাচার্যের সঙ্গে সুনীল ছেত্রী। ফাইল চিত্র।
ছেলের এমন সাফল্যে খড়গ ছেত্রী বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখাতে রাজি নন। কারণ ব্যাখ্যা করে নয়াদিল্লি থেকে টেলিফোনে বলছেন, “আর্জেন্তিনা ও স্পেনের ফুটবলের নিরিখে আমাদের দেশের ফুটবল অনেক পিছিয়ে। মেসি তার দেশ ও বার্সেলোনার হয়ে যে স্তরের ফুটবল খেলে, আমাদের ছেলেরা কিন্তু সেই স্তরের ফুটবলের ধারেকাছে যায়নি। তাই মেসির সঙ্গে তুলনা না করাই ভাল।”
বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ণয় পর্বে প্রায় ২০ বছর পরে বিদেশের মাটিতে দল জিতেছে। ছেলে জয়ে রেখেছেন অবদান। তবে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন জওয়ান মনে করেন সুনীলের হ্যাটট্রিক করা উচিত ছিল। বললেন, “পেনাল্টি বাতিল নিয়ে বেশি কথা বলা উচিত নয়। তবে সুনীল হেড থেকে গোল করতে না পারার জন্য আফসোস হচ্ছিল। ওই বলটা ক্রসবারের উপর দিয়ে না চলে গেলে এই জয় আমাদের কাছে আরও মধুর হত।”
কঠিন ম্যাচ খেলার পর ছেলে ক্লান্ত। তাই ফোনে কথা হয়নি। তবে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাচ নিয়ে বাপ-ব্যাটার আলোচনা হয়েছিল। মেসেজে কী লিখেছিলেন সুনীল? বাবা বলছেন, “সুনীল নিজের থেকেও সতীর্থদের কথা বেশি বলেছে। দুটো গোল করার জন্য সবাই ওর প্রশংসা করলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পুরো দল ভাল ফুটবল খেলেছে। রক্ষণের সঙ্গে মাঝমাঠ ও উইং প্লে ছিল অসাধারণ। ফলে স্ট্রাইকাররা প্রচুর বল পাচ্ছিল।”
৭৯ মিনিটে দলকে প্রথম সাফল্য এনে দিয়েছিলেন সুনীল। আশিক কুরিয়ানের ক্রস থেকে এসেছিল প্রথম গোল। টাচ লাইনের কিছুটা আগে প্রথম পোস্ট থেকে হেড করে দ্বিতীয় পোস্টে বল রাখেন সুনীল। গোলরক্ষক আনিসুর রহমানের পাশ থেকে বল জালে ঢুকে যায়। দ্বিতীয় গোল খেলার ৯২ মিনিটে। সুনীলের ডান পায়ের জোরালো শটে বল দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে জালে ঢুকে যায়। দুটো গোলকেই কুর্নিশ জানাচ্ছেন সুনীলের বাবা ও শ্বশুর মশাই।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জয়ের পর ‘ই’ গ্রুপে ৭ ম্যাচে ৬ পয়েন্ট নিয়ে তিন নম্বরে উঠে এল ভারত। ৫ পয়েন্ট নিয়ে ঠিক পিছনে রয়েছে আফগানিস্তান। ১৫ জুন শেষ ম্যাচে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ড্র করলেও সরাসরি এশিয়ান কাপে খেলার সুযোগ পেয়ে যাবে ‘ব্লু টাইগার্স’রা। কিন্তু প্রশ্ন হল ২০২৩ সালে চিনে আয়োজিত হতে চলা এএফসি এশিয়ান কাপে সুনীল খেলতে পারবেন তো? কারণ তাঁর বয়স তখন বেড়ে হয়ে যাবে ৩৮।
এই বিষয়েও অবশ্য বাবা ও শ্বশুর মশাই ভিন্ন মত জানালেন। সুব্রতর মতে, “সুনীল ফিট থাকার জন্য আলাদা ভাবে অনুশীলন করে। খাওয়া-দাওয়া একেবারে পরিমিত। তাই আমার ধারণা ও অনায়াসে এএফসি এশিয়ান কাপ খেলে দেবে। বিদেশে ক্লাব ফুটবলে ৪০ বছরেও অনেকে খেলে দিচ্ছে। আর সুনীল তো দারুণ ফিট। তাই ওর কোনও সমস্যা হবে না।”
তবে ওঁর বাবা বলছেন, “দুই বছর পরে ওর শারীরিক অবস্থা কেমন থাকবে সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। সুনীল তো খুব জেদি। তাই চেষ্টার খামতি করবে না। তবে ও যদি মনে করে আর মাঠে নামা সম্ভব নয়, তাহলে জোর করে জায়গা দখল করে রাখার ছেলে সুনীল নয়। বাকিটা তো সুনীলের উপর নির্ভর করছে।”