অভিষেক পোড়েল। ছবি: পিটিআই।
গত বছর থেকে আইপিএলে চালু হয়েছে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম। রিকি পন্টিংয়ের মতো বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক মনে করেছিলেন এই নিয়ম অলরাউন্ডারদের প্রয়োজন কমিয়ে দেবে। মানতে চাননি অনেকে। তাঁরা মনে করেছিলেন, ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়মের কারণে এক জন ব্যাটার বা এক জন বোলারকে আরও ভাল ভাবে ব্যবহার করা যাবে। গত বারের সেই নিয়ম রয়েছে এ বারেও। কতটা প্রভাব ইমপ্যাক্ট (প্রভাব) তৈরি করলেন সেই ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারেরা?
ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম আসার পর আইপিএলে ক্রিকেট এখন আর ১১ জনের খেলা নয়। এখন আর প্রথম একাদশ বেছে নিলেই হয় না। বেছে নিতে হয় এক জন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারকেও। ১২ জনের খেলা হয়ে গিয়েছে। আইপিএল কর্তৃপক্ষ এটাও জানিয়ে দিয়েছে যে, টসের আগে দল ঘোষণা করতে হবে না। ফলে টস জিতে বা হেরে দলের অধিনায়ক ঠিক করে নিচ্ছেন বাড়তি ব্যাটার না কি বাড়তি বোলারকে দলে রাখবেন। গত বছর প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে এমনটা হতে। কখনও কখনও প্রয়োজন অনুযায়ী এক জন ব্যাটারের বদলে ব্যাটারকে নামানো হয়েছে। যেমন এ বারের আইপিএলে শনিবার দিল্লি ক্যাপিটালস রিকি ভুঁইয়ের জায়গায় অভিষেক পোড়েলকে নামিয়ে দেয়। কারণ সেই সময় এক জন ব্যাটারকে দলের প্রয়োজন ছিল। অভিষেক ১০ বলে ৩২ রান করে বুঝিয়ে দেন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের প্রভাব কী হতে পারে।
গত বারের আইপিএলে যদিও ব্যাট হাতে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারদের সে ভাবে প্রভাব চোখে পড়েনি। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে নামা ব্যাটারদের গড় ছিল ২০.৬২। স্ট্রাইক রেট ছিল ১২৯.৩। সেখানে গোটা প্রতিযোগিতায় ব্যাটারদের গড় ছিল ২৬.৭২। স্ট্রাইক রেট ১৪১.৭১। হঠাৎ করে ইনিংসের শেষ দিকে ব্যাট করতে নেমে রান করতে পারেননি তাঁরা। বরং বোলারদের প্রভাব বেশি ছিল। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে মাঠে আসা বোলারেরা ৬০টি উইকেট নিয়েছেন। ইকোনমি রেট ৯.১১। সেখানে গোটা প্রতিযোগিতায় বোলারদের ইকোনমি রেট ছিল ৮.৮৪।
গত বছর এই ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের কারণেই নজর কেড়েছিলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের সুযশ শর্মা, গুজরাত টাইটান্সের সাই সুদর্শনের মতো ক্রিকেটারেরা। দেখা নেওয়া যাক কোন দলের কোন ক্রিকেটার গত বছর কতটা প্রভাব ফেলেছিলেন। সেই সঙ্গে এ বারের আইপিএলে ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার হিসাবে কাদের দেখা যেতে পারে, সেই দিকেও নজর থাকবে।
ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের এই নিয়ম ক্রিকেটকে আরও আকর্ষণীয় করেছে বলে মত প্রণব রায়ের। বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার বললেন, “এই নিয়মের কারণে ক্রিকেট এখন ১২ জনের খেলা। সব দল এক জন বাড়তি ব্যাটার বা বোলার খেলাতে পারছে। যে কোনও দলের কাছেই এটা বিরাট সুবিধার। খেলা এখন আরও আকর্ষণীয় হয়েছে। কোচ, অধিনায়কদের কাজ বেড়ে গিয়েছে। এখন ভাবতে হচ্ছে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়েও।”
গত বছর কলকাতা সুযশ শর্মা এবং বেঙ্কটেশ আয়ারকে ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার হিসাবে ব্যবহার করেছিল। কখনও কখনও দেখা গিয়েছিল স্পিনার অনুকূল রায়কে। বেঙ্কটেশ ব্যাট হাতে সে ভাবে প্রভাব ফেলতে পারেননি। কলকাতার ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারেরা ১৩৫ বলে ২০৭ রান করেছিল। দু-একটা ইনিংসেই ভাল খেলতে দেখা গিয়েছিল বেঙ্কটেশকে। বোলারেরা নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। এর মধ্যে সাতটি নিয়েছিলেন সুযশ। এ বারের আইপিএলে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে কলকাতা বেঙ্কটেশ এবং সুযশ ছাড়াও ব্যবহার করতে পারে চেতন সাকারিয়া এবং মণীশ পাণ্ডেকে।
ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার মাঠে নামার সময় যে ভাবে সিদ্ধান্ত জানান আম্পায়ার। —ফাইল চিত্র।
মুম্বই ইন্ডিয়ান্স দল গত বার কোনও এক বা দু’জনের উপর ভরসা করেনি। তারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলিয়েছিল বেশ কিছু ক্রিকেটারকে। কিন্তু তাঁরা সে ভাবে দলকে সাহায্য করতে পারেননি। সব মিলিয়ে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারেরা ব্যাট হাতে করেন ১৩০ রান। বল হাতে নেন ছ’টি উইকেট। এ বারে মুম্বই সূর্যকুমার যাদব, রোহিত শর্মা, কুমার কার্তিকেয়দের ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলাতে পারে।
গুজরাত টাইটান্স কিছু ম্যাচে সুদর্শনকে ব্যবহার করেছিল ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে। শুরুতে শুভমন গিলও ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলেছিলেন। সেই সময় তিনি সে ভাবে রান করতে পারেননি। বিজয় শঙ্করকেও ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিল গুজরাত। তাদের ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারদের ব্যাটিং গড় ২৬.৮৮। ১৭১ বলে ২১৫ রান করেছিলেন তাঁরা। বোলারেরা নিয়েছিলেন মাত্র ৪ উইকেট। এ বারে তারা খেলাতে পারে সুদর্শন, বিজয় শঙ্কর, মোহিত শর্মার মতো ক্রিকেটারদের।
পঞ্জাব কিংস প্রভসিমরণ সিংহ এবং নাথান ইলিসকে ব্যবহার করেছিল। দু’টি ম্যাচে ৪০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। ইলিস বল হাতে সে ভাবে নজর কাড়তে পারেননি। পঞ্জাবের ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলা ব্যাটারেরা ৯৬ বলে ১২৮ রান করেছিলেন। বোলারেরা নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলতে পারেন প্রভসিমরন, ইলিস, অথর্ব তাওড়ের মতো ক্রিকেটারেরা।
গত বারের চ্যাম্পিয়ন চেন্নাই সুপার কিংসের ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলা ব্যাটারেরা সে ভাবে প্রভাব ফেলতে পারেননি। তাঁদের দল এতটাই ভাল খেলেছিল যে, আলাদা করে কোনও ইমপ্যাক্ট ব্যাটারের প্রয়োজন হয়নি। তারা ৭৪ রানের বেশি করতে পারেননি। তবে বোলারেরা অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন। ১২টি উইকেট নিয়েছিলেন তাঁরা। এ বারের আইপিএলে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলতে পারেন শিবম দুবে, মইন আলির মতো ক্রিকেটারেরা।
লখনউ সুপার জায়ান্টসের হয়ে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলেছিলেন আয়ুশ বাদোনি। তাঁকে ফিনিশার হিসাবে খেলিয়েছিল লখনউ। ৮০ বলে মাত্র ১০৩ রান তুলেছিল ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলা ব্যাটারেরা। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলা বোলারেরা নেন ৫ উইকেট। এ বারে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলতে দেখা যেতে পারে যশ ঠাকুর, দেবদত্ত পাড়িক্কল, অমিত মিশ্রদের।
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে প্রথমে খেলিয়েছিল আব্দুল সামাদকে। তিনি সাত নম্বরে নামছিলেন। পরে রাহুল ত্রিপাঠীকে খেলানো হয় তিন নম্বরে। পরে আবার অনমলপ্রীত সিংহকেও খেলানো হয়। কখনও খেলেন ভিভ্রান্ত শর্মা, ওয়াশিংটন সুন্দরও। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলা ব্যাটারেরা ১১৪ রান করেন। বোলারেরা নেন তিনটি উইকেট। এ বারের আইপিএলে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে দেখা যেতে পারে ময়ঙ্ক আগরওয়াল, মার্কো জানসেন, উমরান মালিক, গ্লেন ফিলিপ্সের মতো ক্রিকেটারেরা।
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়েও ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারেরা সে ভাবে নজর কাড়তে পারেননি। অনুজ রাওয়াতকে কয়েকটি ম্যাচে খেলানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি আট নম্বরে নেমে সে ভাবে খেলার সুযোগ পাননি। ফিনিশার হিসাবে কাজটা করতে পারেননি তিনি। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে নামা ব্যাটারেরা করেন ৬৪ রান। বোলারেরা নেন ৬ উইকেট। আরসিবি-ও সে ভাবে নজর কাড়তে পারেনি।
ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলেছিলেন ধ্রুব জুরেল। চাপের মুখে ব্যাট করে নজর কাড়তেই মূল দলে জায়গা করে নেন তিনি। কিন্তু সেই জায়গায় যে ক্রিকেটারেরা ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলেন তাঁরা সে ভাবে নজর কাড়তে পারেননি। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলা ব্যাটারেরা ১০৩ রান করেন। বোলারেরা উইকেট নেন মাত্র দু’টি। এ বারে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলতে পারেন সন্দীপ শর্মা, কুলদীপ সেনের মতো ক্রিকেটারেরা।
দিল্লি ক্যাপিটালস দলও ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে কার্যকরী কাউকে পায়নি। পৃথ্বী শ চার ম্যাচে মাত্র ১৮ রান করেন। রান পাননি সরফরাজ় খান এবং মণীশ পাণ্ডেরাও। বোলারদের মধ্যে মুকেশ কুমার এবং খলিল আহমেদও ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে উইকেট নিতে পারেননি। দিল্লির ব্যাটারেরা ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলতে নেমে ৭০ বলে করেন ৫৮ রান। গড় ৭.২৫। মুকেশও ভাল বল করতে পারেননি। বোলারেরা ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলতে নেমে মাত্র ৫ উইকেট নেন। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে এ বারে দিল্লি খেলাতে পারে অভিষেক পোড়েল, খলিল আহমেদ, শাই হোপদের।
ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার কে হবেন? কোন জায়গায় কাকে নামালে সুবিধা হবে? এই পরিকল্পনাও করতে হচ্ছে কোচদের। ভারতের হয়ে টেস্ট খেলা প্রণব বললেন, “ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে। সেটার জন্য আলাদা অনুশীলনও প্রয়োজন। কোনও ক্রিকেটারকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলানো হবে ঠিক করলে তাঁকে সেই ভাবে তৈরিও করতে হবে। হঠাৎ করে কেউ ১০ বল বাকি থাকতে নেমে চালাতে শুরু করতে পারবে না।”
গত বছর বহু ক্ষেত্রেই ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারেরা সে ভাবে প্রভাব তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু একাধিক ক্রিকেটারকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে এই ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়মের জন্য। এ বারে দলগুলি ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়মকে কী ভাবে কাজে লাগায় সে দিকে নজর থাকবে।