ডুরান্ড কাপ জিতে উল্লাস সবুজ-মেরুন ফুটবলার, সাপোর্ট স্টাফ ও কর্তাদের। ছবি: টুইটার
ডুরান্ড কাপের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছে মোহনবাগান। অনিরুদ্ধ থাপা লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেলেও দিমিত্রি পেত্রাতোসের গোলে লাল-হলুদকে হারিয়েছে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। এই নিয়ে ১৭ বার ডুরান্ড কাপ জিতল মোহনবাগান, যা সর্বাধিক। কিন্তু শেষ বার ২০০০ সালে এই ট্রফি ঢুকেছিল সবুজ-মেরুন তাঁবুতে। তার পরে দু’বার ফাইনাল খেললেও জিততে পারেনি বাগান। ২৩ বছর পরে সেই খরা কাটাল তারা। কিন্তু ৯০ মিনিটের মাঠের লড়াই গড়াল মাঠের বাইরেও। হেরে গিয়ে বাগানকে খোঁচা দিলেন ইস্টবেঙ্গলের কোচ কার্লোস কুয়াদ্রেত। পাল্টা জবাব এল বাগান কোচ জুয়ান ফেরান্দোর কাছ থেকে।
ম্যাচ যে একতরফা হয়েছে তা কোনও ভাবেই বলা যাবে না। গোটা ম্যাচ জুড়েই দু’দলের আক্রমণ এবং প্রতি আক্রমণ দেখা গিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল বেশ কিছু সুযোগ পেয়েছে। কাজে লাগাতে পারলে এই ম্যাচ তারাও জিততে পারত। মোহনবাগানের চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছেন ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা। অতীতে যে ভাবে ডার্বি হলেই একপেশে জিতত মোহনবাগান, তা এ দিন হয়নি। ম্যাচের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আসে ৬০ মিনিটে। লাল কার্ড দেখেন অনিরুদ্ধ। সিভেরিয়ো একটি বল হেড করতে গিয়েছিলেন। আচমকা তাঁর মুখে পা চালিয়ে দেন অনিরুদ্ধ। মোটেই ইচ্ছাকৃত ছিল না। কিন্তু বল ছাড়া এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সরাসরি লাল কার্ড দেখানো হয়। রেফারি অনিরুদ্ধকে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। স্বাভাবিক ভাবেই হতাশ মুখে মাঠ ছাড়েন মোহনবাগানের মিডফিল্ডার। মোহনবাগান দশ জনে হয়ে যাওয়ার পরেও আক্রমণের রাস্তা থেকে সরে আসতে চাননি কোচ জুয়ান ফেরান্দো। কোনও ডিফেন্ডার নামানোর বদলে তিনি হুগো বুমোসের বদলে নামান কামিংসকে। বাঁ দিকে আশিক কুরুনিয়নের বদলে নামেন লিস্টন কোলাসো। সেই সিদ্ধান্তের সুফল মেলে সঙ্গে সঙ্গে। ৭০ মিনিটেই এগিয়ে যায় মোহনবাগান। ডান দিকে বল নিয়ে এগোতে থাকেন পেত্রাতোস। তাঁকে আটকানোর কোনও চেষ্টাই করেননি ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা। বল নিয়ে এগিয়ে আসতে দিলেন। বুমোস সামান্য কাট করে বাঁ পায়ে নিখুঁত শট রাখেন। ইস্টবেঙ্গলের গোলকিপার প্রভসুখন গিলের কিছু করার ছিল না। গোল খাওয়ার পরে অনেক চেষ্টা করেও গোল করতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। হেরে মাঠ ছাড়তে হয় তাদের।
মোহনবাগানের জয়ের কারণ
১০ জনে হয়ে যাওয়ার পরেও হাল ছাড়েনি মোহনবাগান। রক্ষণাত্মক হয়ে পড়েনি তারা। সেই কারণেই প্রতি-আক্রমণ থেকে গোল করতে পারেন বাগানের পেত্রাতোস। মোহনবাগানের কোচ জুয়ান ফেরান্দোর পরিকল্পনা কাজে আসে। প্রথমার্থে পেত্রাতোস তত ভাল খেলতে না পারলেও তাঁকে না তুলে সেমিফাইনালের নায়ক আর্মান্দো সাদিকু ও দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় হুগো বুমোসকে তুলে নেন তিনি। সেই পেত্রাতোসই গোল করে বাগানকে জেতান। শেষ ১৫ মিনিট রক্ষণের ঝাঁপ বন্ধ করে দেন ফেরান্দো। বিদেশি ব্রেন্ডন হামিলকে নামিয়ে দেন তিনি। বাগানের সব ফুটবলারেরা নেমে আসে বক্সে। ফলে অনেক চেষ্টা করেও সমতা ফেরাতে পারেনি লাল-হলুদ।
ইস্টবেঙ্গলের হারের কারণ
সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। গোল করতে না পারার খেসারত দিতে হল দলকে। জেভিয়ার সিভেরিয়োর উপর ভরসা দেখিয়ে তাঁকে আক্রমণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলের কোচ কুয়াদ্রাত। কিন্তু যত ক্ষণ মাঠে ছিলেন নজর কাড়তে পারেননি তিনি। পেত্রাতোসের গোলের ক্ষেত্রে ভুল ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডারদের। তিনি মাঝমাঠে বল ধরে প্রায় ৪০ গজ দৌড়ে যান। লাল-হলুদের কোনও ডিফেন্ডার তাঁকে আটকানোর চেষ্টাই করেননি। আরও আগে চ্যালেঞ্জ করলে হয়তো গোল করতে পারতেন না পেত্রাতোস।
মাঠে দাপট লাল-হলুদের
গ্যালারিতে সবুজ-মেরুন সমর্থকেরা উল্লাস করলেও মাঠে দাপট দেখাল লাল-হলুদ। না, লাল-হলুদ ফুটবলার বা সমর্থকেরা নন, দাপট দেখাল লাল ও হলুদ কার্ড। ম্যাচের প্রথমার্ধেই হলুদ কার্ড দেখেন মোহনবাগানের অনিরুদ্ধ থাপা। দ্বিতীয়ার্ধে ৬০ মিনিটের মাথায় ইস্টবেঙ্গলের জেভিয়ার সিভেরিয়োকে বাজে ফাউল করেন তিনি। সবুজ-মেরুন ফুটবলারেরা রেফারির কাছে মিনতি করছিলেন যে থাপাকে যেন লাল কার্ড দেখানো না হয়। কিন্তু রেফারি তা শোনেননি। তিনি থাপাকে লাল কার্ড দেখান। ১০ জন হয়ে যায় মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গল শিবিরেও এক জন লাল কার্ড দেখেন। তবে তিনি কোনও ফুটবলার নন। লাল-হলুদের সহকারী কোচ ডিমাস ডেলগাডো। তিনি বেশ কয়েক বার রেফারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। বার বার বেঞ্চ ছেড়ে সাইডলাইনে চলে আসছিলেন। ফলে রেফারি তাঁকে লাল কার্ড দেখান। হলুদ কার্ড দেখেন মোহনবাগানের হুগো বুমোস। ইস্টবেঙ্গলের বোরহা হেরেরার সঙ্গে বাদানুবাগে জড়ান তিনি। প্রথমার্ধের একেবারে শেষ দিকে এই ঘটনায় খেলায় ব্যাঘাত ঘটে। সেই কারণে হুগোকে হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। তবে বোরহাকেও কার্ড দেখতে হয়। রেফারির সঙ্গে বিবাদ করে হলুদ কার্ড দেখেন ইস্টবেঙ্গলের কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাত ও আর এক সহকারী কোচ। বাগানের আশিস রাইকেও হলুদ কার্ড দেখান রেফারি।
গুরুতর চোট লাল-হলুদ ডিফেন্ডার জর্ডন এলসের
ডিফেন্ডার জর্ডান এলসের চোট গুরুতর। প্রথমার্ধেই তাঁকে তুলে নিতে বাধ্য হন কুয়াদ্রাত। এলসেকে সোমবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। স্ক্যানের পর বোঝা যাবে কত দিনের জন্যে ছিটকে গেলেন। যদি এই মরসুমে না খেলতে পারেন, তা হলে আর একজন বিদেশি ডিফেন্ডার নিতে পারে ইস্টবেঙ্গল।
মোহনবাগানকে খোঁচা লাল-হলুদ কোচের
ডুরান্ডের গ্রুপ পর্বে ডার্বির পর কুয়াদ্রাত বলেছিলেন, মোহনবাগান নিয়ম ভেঙে ৩৩ জন ফুটবলারকে নথিবদ্ধ করিয়েছে। দুই ডার্বির মাঝে আরও একজন ফুটবলার এসেছেন মোহনবাগানে। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কুয়াদ্রাত বললেন, “একটা জিনিস ভেবে দেখুন। যে কোনও প্রতিযোগিতাতেই একটা নিয়ম থাকে। এখানে ৩০ জন ফুটবলারের রেজিস্ট্রেশন করানোর নিয়ম। কিন্তু ওরা ৩৪ জন ফুটবলারের রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে। সবার জন্যে একটা নিয়ম, বাকিদের জন্যে আলাদা এটা তো হতে পারে না।” সেই সঙ্গে মোহনবাগানের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথাও বলেছেন কুয়াদ্রাত। তাঁর কথায়, “যে কোনও প্রোজেক্ট সফল ভাবে দাঁড় করাতে সময় লাগবে। আমরা গত তিন বছর আইএসএল খেলছি। মোহনবাগানও তিন বছর আগে আইএসএলে এসেছে। প্রথম বার ওরা রানার্স হয়েছিল। বেশির ভাগ প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনাল বা ফাইনালে গিয়েই দৌড় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। এত দিন পর ট্রফি জিতেছে। আইএসএলের পর ডুরান্ড কাপ। ওদের কাছে আর্থিক শক্তিও বেশি ছিল। তাতেও ওদের সময় লেগেছে। তাই এই পদক জিতে আমি গর্বিত। অনেকের কঠোর পরিশ্রম জড়িয়ে আছে এই ফলের পিছনে। এখনও অনেক কাজ করতে হবে আমাদের।”
ইস্টবেঙ্গল কোচকে পাল্টা মোহনবাগান কোচের
বাড়তি চার জন ফুটবলার নথিবদ্ধ করানোর ব্যাপারে ইস্টবেঙ্গলের অভিযোগের পাল্টা বাগান কোচ বলেন, “দলের অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলারেরা চলে গিয়েছে। আমাদের হাতে আর কোনও বিকল্প ছিল না। তা ছাড়া এটা যত দূর জানি নিয়মের মধ্যেই রয়েছে। নিয়ম ভেঙে কোনও কাজ করিনি। আমার মতে, উনিও (ইস্টবেঙ্গল কোচ) নিয়মটা পড়ে দেখলে পারতেন। যদি সে রকমই কিছু হত তা হলে আয়োজকরা শাস্তি দিতে পারতেন। তারা তো সে রকম কিছু করেননি। আমার মনে হয় আলোচনাটা ফুটবলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা ভাল।”
১০ জনে কী ভাবে জয়, ব্যাখ্যা বাগান কোচের
কঠিন পরিস্থিতিতে দলের ছেলেদের কী বলেছিলেন ফেরান্দো? স্প্যানিশ কোচের উত্তর, “দলকে একটা কথা সব সময়েই বলি, কঠিন সময়েই নিজেদের সেরাটা বের করে আনতে হবে। রোজ বলার কারণে এ রকম মুহূর্তে কী করতে হবে সেটা ওরা বুঝে গিয়েছে। তাই আমার কাজ ছিল স্রেফ কৌশলের ব্যাপারটা ঠিক রাখা। বাকিটা ফুটবলারেরাই জানত যে কাকে কী করতে হবে। ও রকম পরিস্থিতিতে থেকেও ম্যাচ বের করার জন্য গোটা কৃতিত্ব দলের।” ফেরান্দোর মতো, অনিরুদ্ধকে লাল কার্ড দেখানোর ক্ষেত্রে রেফারি একটু কড়া মনোভাবই নিয়েছেন। তাঁর কথায়, “মানছি অনিরুদ্ধ দ্বিতীয়ার্ধে একটু ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই সিভেরিয়ো ও ভাবে বলটা পাওয়ায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। কিন্তু রেফারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এক বার ভেবে দেখলে পারতেন। তবে অনিরুদ্ধকে এখনও উন্নতি করতে হবে। আমার বিশ্বাস খুব দ্রুত ও সেটা করে ফেলবে।”