রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। গ্রাফিক— সনৎ সিংহ।
বিশ্ববিদ্যালয় কি শিক্ষা দফতরের? না কি বিশ্ববিদ্যালয় রাজভবনের? রাজ্যের উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? উচ্চশিক্ষা দফতর না কি রাজ্যপাল তথা রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের। এ সংক্রান্ত রাজভবনের সাম্প্রতিক সার্কুলার যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণকে প্রায় নস্যাৎ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে, তখন রাজ্যের শিক্ষাবিদেরা জানালেন, তাঁরা কী মনে করছেন? বিশ্ববিদ্যালয়গুলির রাশ আদতে কার হাতে থাকা উচিত।
কী বলা হয়েছে রাজভবনের বিজ্ঞপ্তিতে?
শনিবার রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য তথা রাজ্যে রাজ্যপালের দফতর থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উদ্দেশে। তাতে বলা হয়েছে, আচার্যের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সার্বভৌম অধিকর্তা হলেন উপাচার্যই। তাঁর অধীনস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা তাঁরই নির্দেশ মেনে কাজ করবেন। সরকার তাঁদের নির্দেশ দিতেই পারে। কিন্তু সেই নির্দেশ তাঁরা মানতে বাধ্য নন। রাজভবন থেকে ওই বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে রাজ্যের সমস্ত সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারের কাছে। তাতে বলা হয়েছে, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রার হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল হর্তাকর্তা। তবে যে হেতু উপাচার্য শিক্ষাগত প্রধান, তাই বাকিরা তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করে চলবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই তাঁর নির্দেশ পালন করবেন। সরকার তাঁদের নির্দেশ দিলেও উপাচার্য অনুমোদন দিলেই তা মান্যতা পাবে। না হলে নয়। এই বিজ্ঞপ্তি ঘিরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। শাসকদল এবং শিক্ষা দফতরের দাবি, উচ্চশিক্ষাকে কুক্ষিগত করতেই রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য তথা রাজ্যপালের এই পদক্ষেপ।
কী বলছেন শিক্ষাবিদেরা?
পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে অনেক কথা বললেও একটি বিষয়ে সবাই একমত। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। তবে একই সঙ্গে রাজ্যে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা উচ্চশিক্ষার নিয়মনীতি মেনে চলার পক্ষে কথা বলেছেন অনেকেই। অস্থায়ী উপাচার্যের বদলে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের কথাও বলেছেন তাঁরা। শিক্ষাবিদদের বক্তব্য, রাজ্যে শিক্ষা নিয়ে যে ডামাডোল চলছে, তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ছাত্রছাত্রীরাই। তাই সঙ্কটের দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার। কারা পক্ষে কথা বলছেন, কারা বিপক্ষে। দেখে নেওয়া যাক।
পক্ষে
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ওমপ্রকাশ মিশ্র
ওমপ্রকাশের বক্তব্য, যা হয়েছে তার পুরোটাই বেআইনি। তাঁর কথায়, ‘‘রাজভবন কি নবান্ন হয়ে গেল?রাজভবন তার সংবিধান-নির্দেশিত কাজ না করে, বিধানসভায় যে বিলগুলি পাশ হয়েছে, সেগুলিতে অনুমোদন না দিয়ে উচ্চশিক্ষাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে চলেছে। এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। রাজভবনের সার্কুলার সম্পূর্ণ বেআইনি। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে আইন রয়েছে, তার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেন না আচার্য। তাঁকে কোনও নির্দিষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তিনি তদারকি করতে পারেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। নিজেকে উপাচার্য হিসাবে ঘোষণা করতে পারেন না। অথচ এই আচার্য উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে আইনবিরুদ্ধ কাজ করতে বাধ্য করছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা উচিত। রাজভবনের বেআইনি কাজগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন রয়েছে। ওই সার্কুলারে যে ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের রাজভবনের অধীনে আনা হচ্ছে তা আদতে আইনের অপব্যাখ্যা।’’
নিমাই চন্দ্র সাহা, প্রাক্তন উপাচার্য, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মনে করেন, নিয়মকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার থাকলেও তারা আইনের উর্ধ্বে নয়। তিনি বলছেন, ‘‘উচ্চশিক্ষা দফতর আর্থিক সাহায্য করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে। উচ্চশিক্ষা দফতরের কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধিকার থাকলেও সেই নিয়মকানুনের বাইরে তো কেউ নয়। নিয়ম না মানলে অনুবর্তিতা থাকবে কী করে। যে নিয়ম এত দিন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তা মানা হবে নাই বা কেন। স্বাধিকার থাকবে। কিন্তু আইনে যা বলা আছে, তাকেও তো মান্যতা দিতে হবে। নিয়মের মধ্যে থেকেই সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। রাজ্যপালও থাকবেন। উচ্চ শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী রয়েছেন, তিনিও থাকবেন। তবে এখন সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এক জন স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা দরকার। সে ব্যাপারে সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ তৈরি হবে। কারণ, উপাচার্য না থাকায় যে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, তার জন্য সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা। মনে রাখতে হবে এত দিন ধরে প্রতিষ্ঠিত একটা সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে বাংলায়। সেটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কী ভাবে, সে ব্যাপারে রাজভবনেরও ভাবা উচিত।’’
রাজভবনের সেই বিজ্ঞপ্তি ।
পবিত্র সরকার, শিক্ষাবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ
শিক্ষাবিদ পবিত্র অবশ্য রাজভবনের বিজ্ঞপ্তির সারমর্ম অনুধাবন করতেই পারছেন না এখনও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যের কথা মানতে হবে। কারণ রাজ্য টাকা দেয়। রাজ্যের বিধানসভায় আইন পাশ করে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাজ্য মাইনেকড়িও দেয়। তাই এই নির্দেশ আমার অদ্ভুত লাগছে। রাজ্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রাজ্যপালের দফতরের নির্দেশ মানতে হবে? এর মাথামুন্ডু আমি বুঝতে পারছি না। রাজ্যপাল নিশ্চয়ই কোনও আইনের ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই এ কথা বলছেন, কিন্তু আমার মনে হয় রাজ্যকে এ ভাবে অগ্রাহ্য করা উপাচার্যদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধিকার আছে ঠিকই কিন্তু তার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি রাজ্যকে এ ভাবে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে আমার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আদালতের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্বিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গে এক ভীষণ রকমের ডামাডোল চলছে। রাজ্যপাল তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন।’’
বিপক্ষে
শুভ্র কমল মুখোপাধ্যায়, অস্থায়ী উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
এটাই তো আইন। মানুষের মধ্যে যে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, আমাদের রাজ্য পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি উচ্চশিক্ষা দফতরের অংশ, তা তো শুধরানো দরকার। আইনে যা আছে তাই হবে। আইন বলছে, উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রধান। চ্যান্সেলরের পরেই তিনি। তাঁর বিশেষ কিছু অধিকারও আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকেরা তাঁর কথা শুনতে বাধ্য। সরকারি সার্কুলার এলেও অধস্তন কর্মীরা উপাচার্যের অনুমতি ছাড়া কিছুই করতে পারেন না।