রোহিত শর্মা। ছবি: পিটিআই।
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৪৭৪ রান তুললেও ভারতকে ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন যশস্বী জয়সওয়াল এবং বিরাট কোহলি। কিন্তু দিনের শেষে এগিয়ে রইল অস্ট্রেলিয়াই। ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মার একাধিক ভুলে কিছুটা সুবিধা পেয়ে গেলেন স্টিভ স্মিথেরা। ব্যাটার হিসাবেও ব্যর্থ রোহিত। প্রশ্নের মুখে রোহিতের নেতৃত্ব। দিনের শেষে ভারত ১৬৪/৫।
প্রথম দিনেই টেস্টে চালকের আসনে ছিল অস্ট্রেলিয়া। টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন প্যাট কামিন্স। তাঁর দলের ব্যাটারেরা একের পর এক অর্ধশতরান করেন। ওপেনার স্যাম কনস্টাস অভিষেক ম্যাচে ৬৫ বলে ৬০ রান করেন। একের পর এক ছক্কা মারেন। প্রথম দিনে রান করেন উসমান খোয়াজা (৫৭), মার্নাস লাবুশেন (৭২) এবং অ্যালেক্স ক্যারেও (৩১)। স্টিভ স্মিথ অপরাজিত ছিলেন ৬৮ রানে। দ্বিতীয় দিনে তিনি শেষ করেন ১৪০ রানে। কামিন্স করেন ৪৯ রান। তাঁদের দাপটে ৪৭৪ রান তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু দোষ এড়িয়ে যেতে পারবেন না রোহিত।
দ্বিতীয় দিনের শুরুতে রোহিত বল তুলে দেন মহম্মদ সিরাজের হাতে। তিনি প্রথম ওভারেই ৯ রান দেন। উল্টো দিক থেকে আকাশ দীপকে শুরু করান ভারত অধিনায়ক। তৃতীয় ওভারে আবার যশপ্রীত বুমরাকে নিয়ে আসেন রোহিত। প্রথম দিনের শেষ ওভারটি করেছিলেন বুমরা। সেই কারণে তাঁকে প্রথম ওভার দেওয়া যায়নি দ্বিতীয় দিনে। আবার সিরাজ যে দিক থেকে ওভার শুরু করেছিলেন, সেই দিক থেকেই বুমরাকে বল করানোর পরিকল্পনা ছিল রোহিতের। তাই এক ওভার করিয়েই সিরাজকে সরিয়ে দেন তিনি। কিন্তু প্রথম ওভারেই ৯ রানের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াকে আত্মবিশ্বাসও দিয়ে যান ভারতীয় পেসার। বুমরা ছাড়া আর কোনও পেসার সে ভাবে ছাপ ফেলতে পারছিলেন না। কিন্তু মেলবোর্নে ভারতীয় দলে দু’জন স্পিনারকে নেওয়া হয়েছে। অথচ রোহিত তাঁদের দিয়ে মাত্র ৩৮ ওভার বল করালেন। রবীন্দ্র জাডেজা এবং ওয়াশিংটন সুন্দরকে প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনেও অনেক দেরিতে বল করতে পাঠালেন। ফলে বাড়তি স্পিনার নিলেও তাদের কাজে লাগাতে পারল না ভারত।
রোহিতের এমন নেতৃত্বের সমালোচনা শোনা গেল রবি শাস্ত্রীর গলায়। ভারতের প্রাক্তন কোচ বলেন, “যদি ৪০ ওভারের পর বল করাতে হয় তা হলে দলে দু’জন স্পিনার নেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? মেলবোর্নে অবশ্যই ইনিংসের অর্ধেক ওভার স্পিনারদের দিয়ে করানো উচিত। আমি বুঝলাম না কেন জাডেজা এবং ওয়াশিংটনকে ৪০ ওভারের পর বল করতে পাঠানো হল।” অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ভারত ১২২.৪ ওভার বল করেছে। তার মধ্যে স্পিনারেরা করেছেন মাত্র ৩৮ ওভার। দুই স্পিনার মিলে যদিও চারটি উইকেট তুলে নিয়েছেন। বুমরা একা নিয়েছে চার উইকেট। এবং দু’টি উইকেট আকাশের। তবে বাংলার পেসারকে উইকেট উপহার দিয়ে গিয়েছেন স্মিথ। বল তাঁর ব্যাটে লাগার পর প্যাডে লাগে। তার পর ড্রপ খেতে খেতে চলে যায় উইকেটে। স্মিথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন তাঁর উইকেট ভেঙে গেল। বল আটকানোর চেষ্টাই করলেন না ১৪০ রান করা ব্যাটার।
সিরাজকে প্রথম ওভার দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যে পেসার ২৩ ওভারে ১২২ রান দিয়েছেন, আগের ম্যাচগুলিতেও সে ভাবে নজর কাড়তে পারেননি, তাঁকে দিয়ে আক্রমণ শুরু করা কতটা উচিত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। দ্বিতীয় দিনের প্রথম ওভার বুমরাকে দিয়ে করানোর পরিকল্পনা যদি রোহিত আগে থেকে করতেন, তা হলে অবশ্যই প্রথম দিনের শেষ ওভারটি তাঁকে দিয়ে করাতেন না। কিন্তু পরের দিনের ভাবনা হয়তো ভারত অধিনায়কের মাথায় ছিল না। শাস্ত্রী বলেন, “ভারতের উচিত ছিল বুমরাকে দিয়ে শুরু করা। কিন্তু সিরাজ প্রথম ওভার করল। ওর আত্মবিশ্বাস এখন তলানিতে। ভারতের উচিত সিরাজকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করা।” কার পরে কোন বোলারকে বল করানো উচিত, সেই পরিকল্পনা কি রোহিত ঠিক মতো করেছেন মেলবোর্ন টেস্টে?
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রোহিতের ওপেন করা নিয়েও। এ বারের অস্ট্রেলিয়া সফরে ভারতের সফলতম ব্যাটার লোকেশ রাহুল। তিনিই একমাত্র নতুন বলটি ঠিক মতো সামলাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রথম তিনটি টেস্টে ওপেন করা সেই রাহুলকে মেলবোর্নে তিন নম্বরে পাঠিয়ে নিজে ওপেন করতে নামলেন রোহিত। মিডল অর্ডারে রান পাচ্ছিলেন না তিনি। পুরনো জায়গায় ফিরেও রান পেলেন না। মাত্র ৩ রান করে আউট হয়ে গেলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠবে আউট হওয়ার ধরন নিয়ে। কামিন্সের বাউন্সারে পুল মারতে গিয়েছিলেন রোহিত। ইনিংসের সেটি দ্বিতীয় ওভার। রোহিতের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটারের কি ৪৭৪ রানের বোঝা মাথায় নিয়ে এমন ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হল? রোহিত এর আগেও বার বার পুল মারতে গিয়ে আউট হয়েছেন। শুক্রবারও হলেন। বল ঠিক মতো ব্যাটে লাগেনি। মিড-অনে স্কট বোলান্ডের হাতে ক্যাচ চলে যায়। সাজঘরে ফিরে যান রোহিত।
রোহিত আউট হওয়ার পর ইনিংস গড়ার কাজটা শুরু করেন যশস্বী এবং তিন নম্বরে নামা রাহুল। তাঁরা ৪৩ রানের জুটি গড়েন। কিন্তু চা বিরতিতে যাওয়ার আগের বলে আউট হন রাহুল। ক্রিজ়ে জমে গিয়েও উইকেট দিয়ে এলেন তিনি। কামিন্সের বল ভুল লাইনে খেললেন। তাতেই বোল্ড হয়ে যান রাহুল। তবে চা বিরতির পর বিরাট কোহলি এবং যশস্বী মিলে যে ক্রিকেটটা খেলছিলেন, সেটা দেখার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন সমর্থকেরা। নিখুঁত কভার ড্রাইভ মারছিলেন বিরাট। বোলারের মাথার উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাচ্ছিলেন তরুণ যশস্বী। তাঁরা দু’জনে ১০২ রানের জুটি গড়ে ফেলেছিলেন। মনে করা হচ্ছিল, দিনের বাকি সময়টুকু কাটিয়ে শনিবার সকালে আবার তাঁরাই ব্যাট করতে নামবেন। কিন্তু ভারতের একটি ভুলে দিনের শেষে হাসিমুখে সাজঘরে ফিরলেন কামিন্সেরা।
ভারতের ইনিংসের ৪১তম ওভারটি করছিলেন বোলান্ড। তাঁর ওভারের শেষ বলটি মিড অনের দিকে ঠেলে দিয়েই রান নেওয়ার জন্য ক্রিজ় ছাড়েন। বিরাটকে রান নেওয়ার জন্য ডাকও দিয়েছিলেন। কিন্তু নন-স্ট্রাইকারের দিকে থাকা বিরাট দেখেন বল সোজা মিড অনে দাঁড়ানো কামিন্সের হাতে যাচ্ছে। যশস্বীর ডাকে তাই সাড়া দেননি বিরাট। তিনি নন-স্ট্রাইকারের ক্রিজ়েই থেকে যান। কিন্তু তরুণ যশস্বী তত ক্ষণে মাঝ ক্রিজ়ে। তাঁর পক্ষে আর ফেরা সম্ভব ছিল না। রান আউট হয়ে যান তিনি। সাধারণত এই ধরনের ক্ষেত্রে ব্যাটার যদি রান নেওয়ার জন্য ডাকেন, তা হলে নন-স্ট্রাইকারের উচিত সেই ডাকে সাড়া দেওয়া। যশস্বী আউট হওয়ার পর বিরাট হাত দিয়ে বোঝান তিনি ডাক শুনতে পাননি। কিন্তু বিরাট পিছন দিকে তাকিয়ে দেখেন বল সোজা ফিল্ডারের হাতে যাচ্ছে। রান নিতে গেলে আউট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সেই কারণেই তিনি রান নিতে চাননি। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির স্বীকার হলেন যশস্বী। প্রশ্ন উঠবেই দিনের শেষ বেলায় কেন হঠাৎ এত ঝুঁকি নিয়ে রান নিতে গেলেন তিনি। বিরাট যদি যশস্বীর ডাকে সাড়া দিতেন তা হলেও রান আউট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল।
যশস্বী আউট হওয়ার পর আর বেশি ক্ষণ ক্রিজ়ে টিকতে পারেননি বিরাট। বোলান্ডের পরের ওভারেই অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিলেন তিনি। এত ক্ষণ এই ধরনের বলে ব্যাট এগোচ্ছিলেন না। কিন্তু যশস্বীর আউট তাঁর মনঃসংযোগ নষ্ট করে। পুরনো ভুল আবার করেন বিরাট। ফল ৩৬ রানে আউট। নৈশপ্রহরী হিসাবে নামা আকাশও ১৩ বলের বেশি খেলতে পারেননি। রোহিতের সেই সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রায় ২৫ মিনিট খেলা বাকি থাকতেও কেন নৈশপ্রহরী নামাল ভারত? ব্যাটারদের আত্মবিশ্বাস এতটাই তলানিতে যে দিনের শেষ কয়েকটা ওভারও খেলতে পারবেন না? শেষ পর্যন্ত যদিও ঋষভ পন্থ (৬ রানে অপরাজিত) এবং জাডেজাকে (৪ রানে অপরাজিত) নামতেই হয়। দিনের শেষে ভারত ১৬৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে প্রবল চাপে। কারণে এই টেস্টে এক জন ব্যাটার কম খেলাচ্ছে তারা। প্রথম একাদশ বাছাইয়ের সেই ভুলের খেসারত না দিতে হয় অধিনায়ক রোহিতকে।