গার্ড মুলার ফাইল চিত্র
১৯৭০ বিশ্বকাপে ১০টি গোল, সোনার বুট। পরের বিশ্বকাপে ফাইনালে জয়সূচক গোল-সহ মোট চার গোল। দুটি বিশ্বকাপ মিলিয়ে ১৪ গোল। বিশ্বকাপে সবথেকে বেশি গোল করার রেকর্ড ৩২ বছর তাঁর দখলে ছিল। জনসাধারণের ভোটে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে হারিয়ে বুন্দেশলিগার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ফুটবলার।
এই তথ্যগুলো মাথায় নিয়ে গার্ড মুলারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার ঠিক এক বছর আগে কলকাতায় দিয়েগো মারাদোনার সাংবাদিক সম্মেলন করতে গিয়ে যে শিহরণ হয়েছিল, ঠিক একই রকম পেট গুড়গুড় ছিল সে বারও।
সালটা ২০০৯। বায়ার্ন মিউনিখের দ্বিতীয় দল নিয়ে ১২ বছর আগে কলকাতায় এসেছিলেন মুলার। টমাস মুলার, হলগার ব্যাডসটিউবারদের নিয়ে তৈরি সেই দলের তখন তিনি সহকারী কোচ। বর্ধমানে বায়ার্নের যে ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরির কথা ছিল, তারই অঙ্গ হিসেবে তারা দ্বিতীয় দলটিকে কলকাতায় পাঠিয়েছিল।
কলকাতায় যাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম কৌশিক মৌলিক মুলারের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কলকাতার একটি হোটেলে প্রাতরাশের আমন্ত্রণ। আয়োজক কৌশিক। অতিথি মুলার। দ্বিতীয় অতিথি আমি, এটা ভেবে তখন যেরকম শ্লাঘা বোধ হয়েছিল, সাক্ষাতের পর এবং ১২ বছর পরে মুলারের প্রয়াত হওয়ার দিনে সেই শ্লাঘা হতাশায় পরিণত হয়েছে।
শুধু সে দিন নয়, তারপর যে কটা দিন কলকাতায় ছিলেন, রোজই সাক্ষাৎ হয়েছে মুলারের সঙ্গে। কখনও প্রাতরাশ, কখনও মধ্যাহ্নভোজ, কখনও নৈশভোজ। স্থান একই, তিনজন মানুষও এক, শুধু ‘হোস্ট’ বদলেছে।
খুদে ফুটবলারদের সঙ্গে মুলার ফাইল চিত্র
হোটেলে ঢুকে দেখি লবিতে কৌশিক অপেক্ষা করছে। হাত নাড়লাম। কৌশিকও হাত নাড়ল। দেখি পাশ থেকে আর একজন ‘হাই ইউ’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় কোলে উঠে পড়ছে। কিছু বোঝার আগেই হাতটা বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন। লোকটির কাঁধে তখন আমার মাথা। কৌশিককে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনিই’? বলল, ‘হ্যাঁ, ইনিই গার্ড মুলার’।
মারাদোনার পর এই প্রথম একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে আগের দিন থেকে একটা প্রস্তুতি ছিল। কত বার ভেবেছি, প্রথম সম্বোধন কী ভাবে করব। সবার আগে মিনিট খানেক মানুষটাকে আপাদমস্তক দেখে নেব। কোথায় কী? এক করমর্দন আর আলিঙ্গনে সব প্রস্তুতি, সব আশায় জল ঢেলে দিলেন। ইনিই গার্ড মুলার?
তখনও দেখাই হয়নি তিনি কী পরে আছেন। আলিঙ্গনমুক্ত হওয়ার পর দেখলাম, লাল রঙের জার্সি, বুকে বায়ার্ন মিউনিখের লোগো। সঙ্গে কালো শর্টস, স্পোর্টস জুতো।
না, আর তো কোনও শিহরণ নেই, গায়ে কাঁটা দেওয়া নেই, পেট গুড়গুড় নেই। এ তো বাজার করতে গিয়ে অনেক দিন পরে পাশের পাড়ার জ্যেঠুর সঙ্গে দেখা হওয়া। এমনিতে ৫ ফুট ৯ ইঞ্চির ছোটখাটো চেহারার মানুষটার মধ্যে ইউরোপীয় ছোঁয়া কম, বরং ভারতীয় বলে মনে হবে।
আড্ডা যে খুব জমল, তা নয়। তার একমাত্র কারণ, মুলার ইংরাজি একেবারেই জানতেন না। শুরুতে ‘হাই ইউ’, ওখানেই শেষ। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে হতাশা তত বেড়েছে। প্রথমেই কী খাব জানতে চেয়ে হোটেলের খাদ্য তালিকাটা নিজেই আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। দু-একটায় আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, এগুলো তিনি চেখে দেখেছেন, খেতে পারি। ইনিই গার্ড মুলার?
একমাত্র খাওয়ার ধরনে কিছুটা সাহেবিয়ানা লক্ষ্য করলাম। ডিশের পাশে রাখা রুমাল দিয়ে নিজের কোল ঢাকলেন। চামচ, কাঁটা চামচ, ছুরি দিয়ে বেশ পরিপাটি করে খেলেন।
তার মাঝে দলের দুই ফুটবলার এসে কিছু বলে গেলেন। মুলারের তাকানো বা জবাব দেওয়ার ধরনে মনে হল, বাবার কাছে ছেলেরা কিছু একটা আব্দার করতে এসেছে। আর বাবা তাতে সায় দিচ্ছে। সঙ্গে এটাও বলে দিচ্ছে, যা করার শৃঙ্খলা, সীমার মধ্যে থেকে যেন করা হয়। তাঁরা যখন চলে যাচ্ছেন, একজনকে নাম ধরে ডাকলেন। তাঁর জার্সি থেকে একটু সুতো ঝুলছিল। হাত দিয়ে ছিঁড়ে দিলেন। ইনিই গার্ড মুলার?
খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর যখন উঠব উঠব করছি, তখন বোঝালেন, চাইলে অনুশীলনেও থাকতে পারি। এই সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্ন নেই। যাক, এ বার অন্তত আসল মুলারকে খানিকটা দেখতে পাব। তখনও ছোট মুলারকে (টমাস) চিনত না ফুটবল বিশ্ব। ফলে তাঁর দিকে নজর রাখার কোনও ব্যাপার ছিল না। চোখ শুধু বড় মুলারের দিকে। অনুশীলন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি বড় মুলার হাঁটু মুড়ে বসে কী একটা করছেন। দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম, কোনও এক ‘সন্তান’-এর জুতোয় কিছু সমস্যা হয়েছে। ‘বাবা’ সেটা ঠিক করে দিচ্ছেন। ইনিই গার্ড মুলার?
কলকাতায় মুলার ফাইল চিত্র
অনুশীলন শেষ হওয়ার পর আবার আমাদের দেখে হাত নাড়লেন। যেন তিনিই সারাক্ষণ খুঁজছেন আমাদের। বুঝিয়ে দিলেন, একটু অপেক্ষা করতে হবে, তিনি যত দ্রুত সম্ভব আসছেন। মিনিট দশেকের মধ্যে চলে এলেন। বেরনোর সময় পরের দিনের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। বারবার। কার্যত অনুরোধ। ইনিই গার্ড মুলার?
কলকাতায় মুলারের সংবর্ধনা টুইটার
বিষয়টি ততক্ষণে এরকম জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, উনিই আমাদের দেখতে কলকাতায় এসেছেন। হতাশা ছেড়ে বিড়ম্বনা হল। কিন্তু বুঝলাম, ইনিই গার্ড মুলার। এক সময়ের বিশ্বরেকর্ডধারী, বিশ্বকাপজয়ী, বুন্দেশলিগার সেরা ফুটবলারে সম্মানিত, আরও অসংখ্য কীর্তির অধিকারী- মানুষ মুলারের সান্নিধ্যে এলে এগুলি আর গায়ে কাঁটা দেওয়াবে না, পেট গুড়গুড় করাবে না। শুধুই হতাশ করবে। তিনি প্রয়াত হলেন। কিন্তু যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের মনে বারবার একটাই প্রশ্ন উঠবে, ইনিই গার্ড মুলার?