খে লা কোব্বে’, বেউ বেউ যাবে’, ‘দুত্তু কয়ে না’— বাড়িতে কোনও শিশু থাকলে এই সব অর্থহীন কথা প্রায়ই শোনা যায়। ‘অর্থহীন’ বললাম বলে কেউ হয়তো চটতে পারেন, ভাবতে পারেন যে আদর দেওয়ায় আপত্তি কিসের! কিন্তু এ ভাবে শিশুর সঙ্গে কথা বলা ঘোর অনুচিত। কারণ নিয়ে আলোচনার আগে, শিশু কী ভাবে ভাষা শেখে সে সম্পর্কে বলতে হয়।
মায়ের গর্ভে থাকার সময়ই শিশুর শব্দ শোনার ক্ষমতা তৈরি হয়। বাইরের জগতের কথাবার্তা বা আওয়াজ কিছু তার কানে যায়। সে স্পষ্ট শোনে মায়ের হৃদ্স্পন্দনের শব্দ। জন্মের পর দু’মাস তার জিভের নড়াচড়া থাকে না। কথা বলার চেষ্টা করলেও সে পারে না। এ সময় শিশু পরীক্ষা করে দেখে, চার পাশের শব্দ সে নিজেও তৈরি করতে পারছে কি না। এই পর্বের নাম ‘কুইং’। তৃতীয় মাস থেকে জিভের নড়াচড়া শুরু হলে এক-আধটা ধ্বনি বেরোয়। প্রথমে শুধুই স্বরধ্বনি— মানুষের উচ্চারণের প্রাথমিক আওয়াজ। মুখের ভেতর কোথাও ধাক্কা না খেয়ে, জিভের কায়দা না করে, শুধু ঠোঁট সামান্য এ দিক-ও দিক নাড়িয়ে মুখ দিয়ে শ্বাসবায়ু বার করে তৈরি হয় স্বরধ্বনি। বাংলায় ‘প্রাইমারি কার্ডিনাল ভাওয়েল’ বা প্রাথমিক মৌলিক স্বরধ্বনি সাতটা: ই, এ, এ্যা, আ, অ, ও, উ।
পাঁচ থেকে সাত মাস বয়সে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের শুরু। এখানে জিভ-ঠোঁটের কায়দা-কানুন জানতে হয়, শ্বাসবায়ু আটকা পড়ে। এই পর্যায়ে শিশু যে সব শব্দ বলে, তা একেবারেই আবোল-তাবোল, তাকে বলে ‘ব্যাবলিং’। কিন্তু ক্রমাগত আবোল-তাবোল শব্দ বলতে বলতেই এক সময় সেগুলোকে ঠিকমতো পর পর সাজাতে শিখে যায় সে। খেলাচ্ছলেই ধ্বনির গুচ্ছ তৈরি করতে পারে। এ ভাবেই এক দিন আস্ত একটা ‘সিলেবল’ বা অক্ষর সে বলতে পারে। এক শ্বাসে আমরা যতখানি ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারি, তাকে বলে ‘অক্ষর’। যেমন, ‘আমাদের’ শব্দে ‘আ’, ‘মা’ ও ‘দের’ হল তিনটে অক্ষর। আবোল-তাবোল বকতে বকতে শিশুর বাক্যন্ত্রও পরিণত হয়। জিভের ক্রমাগত নড়াচড়া, ঠোঁটের খোলা-বন্ধ হওয়া, নাক কুঁচকানো ইত্যাদি সমস্ত কাজকর্মই কথা বলার প্রক্রিয়াটাকে সহজ করে তোলে। এটা আসলে কথা বলার যন্ত্রকে সচল ও মসৃণ করার স্বাভাবিক ব্যায়াম। এই সময় শিশু বুঝতে পারে যে কথা বলতে গেলে জিভ নাড়তে হবে। যে শিশু ছ’মাস বয়সে ধ্বনি বুঝতে পারে এবং সেগুলোকে নিজের মতো করে জুড়তে শেখে, সে আর মাস চারেকের মধ্যে একটা গোটা অক্ষর উচ্চারণ করে ফেলে।
এক থেকে দেড় বছর বয়সে অক্ষর জুড়ে জুড়ে গোটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারে শিশু। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আর অসুবিধে থাকে না। তবে তখন এক-আধটা শব্দেই মনের ভাব প্রকাশিত হয়, পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো পূর্ণ বাক্যে নয়। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ জেমস ব্রিটন কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। আমরা বলি: ‘ফ্রেজ়ার উইল বি আনহ্যাপি’; শিশু বলে: ‘ফ্রেজ়ার আনহ্যাপি’। অনেকটা বাদ দিয়েই সে নকল করে। খিদে পেলে কোনও শিশু কি ‘আমার খিদে পেয়েছে’ বলে? সে শুধু বলে: ‘খিদে’। অর্থাৎ একটা শব্দই তার একটা পদের গুচ্ছ বা একটা বাক্য। এর নাম ‘হোলোফ্রেসটিক স্পিচ’।
তার পর শব্দ জুড়ে জুড়ে পদগুচ্ছ বলতে শেখা, মনের ভাব আরও স্পষ্ট করে জানানো। তখন শিশু ‘খিদে পেয়েছে’ বা ‘খেলা করব’ বলতে পারে। এটা হল ‘টু ওয়ার্ড স্টেজ’ বা দুই শব্দের পর্যায়। ব্যাকরণের ধারণা তৈরি হতে অবশ্য দুই থেকে তিন বছর বয়স হতে হয়। তার আগে অবধি কথায় অর্থ তৈরি হলেও ব্যাকরণের নিয়মকানুন মানা হয় না। ব্যাপারটা অনেকটা টেলিগ্রামের ভাষার মতো, যেখানে সম্পূর্ণ বাক্য বা যতিচিহ্নের কোনও ব্যাপার নেই। ৩০ মাস বয়স থেকে মনের ভাব আস্ত একটা বাক্যে সাজিয়ে বলতে পারে সে।
ভাষাবিজ্ঞানী নোম চমস্কির তত্ত্ব অনুযায়ী, বড়দের মস্তিষ্কের যে অংশগুলো ভাষা শেখা ও ভাষা তৈরির জন্য দায়ী, সেগুলো বিদ্যমান শিশুদের মস্তিষ্কেও।
ফিরে আসা যাক গোড়ার প্রশ্নে। আধো আধো কথা বলায় ভ্রান্তি কোথায়? ওপরের পুরো প্রক্রিয়াটা থেকে বোঝা যায় যে শিশুর ভাষা শেখার পদ্ধতটা হল অনুকরণ। চার পাশের লোকেদেরই যদি সে আধো আধো করে কথা বলতে শোনে, তা হলে সেটাই নকল করার চেষ্টা করবে। শিশুকে শেখাতে হবে, ওই যানটার নাম ‘গায়ি’ নয়, ‘গাড়ি’। এই ঘটনাকে বলা হয় ‘ভোকাল মিমিক্রি’। ২০১০ সালে ব্রেন অ্যান্ড ল্যাঙ্গোয়েজ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে পিটার টার্কেলটাব ও ব্রাঞ্চ ক্লোসেট দেখিয়েছিলেন, মস্তিষ্কের অডিটরি ডর্সাল সিস্টেম শব্দ শুনে অনুকরণের কাজটা শুরু করে। এই অংশটির পাঠানো সিগন্যাল মস্তিষ্কের সুপিরিয়র টেম্পোরাল গাইরাস-এ পৌঁছে অনুকরণের কাজটা করে থাকে। মনে রাখতে হবে, ভাষাহীন অবস্থায় একটা প্রাণ এই ভাষাময় দুনিয়ায় উপস্থিত হয়। তার অবস্থা হয় অকূল পাথারে পড়ার মতো, সাঁতার না জেনে জলে পড়ার মতো। এই অবস্থায় তাকে পৃথিবীর সঙ্গে যোগস্থাপনের জন্য ঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব অভিজ্ঞদেরই।
ভাষা শেখার এই তত্ত্বের প্রবক্তা বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী নোম চমস্কি। তাঁর মতবাদের দুটো মূল ভিত্তি: ‘ইনেট নলেজ’ বা সহজাত জ্ঞান ও ভাষা অধিগ্রহণের ক্ষমতা, এবং পর্যায়ক্রমে ভাষা শেখা। ১৯৮১ সালের তত্ত্বে চমস্কি বলেছিলেন, শিশু যখন ভাষা (বিশেষত মাতৃভাষা) শেখে, তখন ভাষা শেখার মৌলিক দিকগুলো তার সহজাত; জন্মের পর মানুষের মনের ভেতরেই ভাষার নিয়মকানুন নির্ধারিত অবস্থায় থাকে। এই প্রস্তাবকে ‘ইনেটনেস হাইপোথিসিস’ বলা হয়। তাঁর মতে, এক জন বয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের যে যে অংশে ভাষা শেখার কাজকর্ম হয়, শিশুর মস্তিষ্কেও সেই জায়গাগুলি থাকে। এই তত্ত্ব আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ তথ্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭২ সালে ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যান্ড মাইন্ড বইয়ে চমস্কি বলছেন, ভাষা শেখার নানা কৌশল আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যেই থাকে। তা শিখতে জিনগত সাহায্য পায় শিশু। স্বাভাবিক ভাষায় সম্ভব-অসম্ভব সমস্ত নিয়ম নিয়ে তার মনের মধ্যেই একটা এলাকা তৈরি হয়, যাকে ‘ল্যাঙ্গোয়েজ ফ্যাকাল্টি’ বা ‘ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যাকুইজ়িশন ডিভাইস’ (এলএডি) বলা হয়। এর পর সে চার পাশ থেকে ভাষা গ্রহণ করতে থাকে, যার মধ্যে ঠিক-ভুল সবই আছে, ব্যাকরণের নিয়মও পুরোপুরি মানা হয় না। এলএডি-র সাহায্যেই সে ভুলগুলোকে বাদ দিতে পারে। স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় ভাষাবিজ্ঞানের এলএডি হল ওয়েরনিকস এরিয়া ও ব্রোকাস এরিয়া। ১৮৬১ সালে পল ব্রোকা প্রথম দেখান যে, মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশে সমস্যা দেখা দিলে বাক্য গঠনে অসুবিধে হয়। তার ১৩ বছর পরে কার্ল ওয়েরনিক দেখান, মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ শব্দ শুনতে, শব্দ অনুকরণ করতে এবং শব্দ উচ্চারণ করতে কাজে লাগে। বিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রোকা ও ওয়েরনিকের তত্ত্বকেই নতুন রূপে প্রকাশ করেন নর্ম্যান জেসউইন্ড। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মস্তিষ্কে একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা ওয়েরনিক-জেসউইন্ড পাথওয়ে নামে পরিচিত। মস্তিষ্ক কী ভাবে শব্দ শোনে, শব্দ তৈরি করে এবং উচ্চারণ করে, তা জানান দেয় এই নেটওয়ার্ক। আধুনিক গবেষণা প্রমাণ করেছে, শিশুদের মস্তিষ্কে এই নেটওয়ার্ক কাজ করা শুরু করে খুব কম বয়স থেকেই।
ধীরে ধীরে ব্যাকরণের জটিল ধারণাগুলো শিশু স্বাভাবিক ভাবেই অর্জন করে। তা হাত-পা চালাতে শেখার মতোই স্বাভাবিক। আগে জটিল ব্যাকরণ শেখা, তার পর নিয়ম অনুসারে মাতৃভাষা বলা, পদ্ধতিটা এমন নয়। শেখার প্রক্রিয়াটা নিজে নিজেই অভিজ্ঞতা থেকে হয়, তার মধ্যে জটিল ব্যাকরণও থাকে। এই ব্যাকরণকে চমস্কি নাম দিয়েছেন ‘ইউনিভার্সাল গ্রামার’। এই নিয়মের সাহায্যে সমস্ত ব্যাকরণগত সূত্র শারীরগত ভাবে সহজাত পদ্ধতির অংশ হয়ে যায়। জন্মের পরে শিশু নিজে থেকেই জানে যে ভাষা ব্যবহার যেমন-তেমন নয়, তার কিছু নিয়ম আছে। সেগুলো সে স্বজ্ঞায় ধীরে ধীরে বুঝে নেয়। যে কারণে ব্যাকরণের শিক্ষা না থাকা কোনও মানুষও মাতৃভাষায় দিব্যি জটিল বাক্যে কথা বলতে পারেন।
চমস্কির ‘থিয়োরি অব ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যাকুইজ়িশন’ বা ভাষা শেখার তত্ত্বের বিরোধী মতও আছে। সুইস মনোবিদ জঁ পিয়াজে শিশুর জ্ঞান বিকাশের চারটে ধাপের কথা বলেছিলেন। প্রথম দু’বছর ‘সেন্সরি মোটর স্টেজ’। তখন কেবল চার পাশের শব্দগুলো নকল করা, মুখের ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। দুই থেকে ছ’বছর ‘প্রি অপারেশনাল স্টেজ’। এ সময় বোঝানোর ক্ষমতা তৈরি হয়, কিছুটা বোঝার ক্ষমতাও। তবে খুব জটিল কিছু বলতে পারে না সে। সাত থেকে বারো বছর অবধি ‘কংক্রিট অপারেশনাল স্টেজ’। তখন সে অন্যের ভাবনা বুঝতে পারে, যুক্তিক্রম তৈরি করতে পারে। আর এ সবই হয় ভাষা দিয়ে। বারোর পরে ‘ফর্মাল অপারেশনাল স্টেজ’। এ বার সম্পূর্ণ বোঝা-শোনার পালা, বিমূর্ত সব ভাবনাও। আবার ১৯৬০-এর দশকে ভাষাবিজ্ঞানী সুজ়ান ল্যাঙ্গারও বলেছিলেন, কথা বলার আগে শিশুর ভাষা সম্পর্কে কোনও ধারণা থাকে না, থাকে শুধু ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধি। জন্ম থেকে দু’বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর সচেতন ভাবে মোটর শক্তি প্রয়োগের সময়। যে ব্যবস্থায় মস্তিষ্ক আমাদের ‘মুভমেন্ট’ বা চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে, তা-ই হল মোটর শক্তি।
মতবিরোধ যা-ই থাকুক, একটা কথা স্পষ্ট যে, চার পাশে সারা ক্ষণ যে ভাষা শুনতে শুনতে শিশু বড় হয়, তার সঙ্গে যোগাযোগের ইচ্ছেই তার প্রবল। সে শুধু ধ্বনি শোনে না, শোনে বক্তব্য। কথা বলার চেষ্টাও সেখান থেকেই। বড়বেলায় নতুন ভাষা শিক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে খানিকটা বুঝতে সুবিধে হবে। শব্দ শেখা, পদগুচ্ছ বলা, বাক্য তৈরি— ধাপে ধাপে এগোনো। অনেকেরই অভিজ্ঞতা আছে, যে শিশু চারপাশে খুব কম কথা শোনে, তার বুলি ফোটে দেরিতে। বোঝা যায়, ঠিক পথ দেখানোটা কতটা জরুরি।