Mahalaya Special

জাঁকজমক নয়, আন্তরিকতায় ভরপুর গ্রামের বাড়ির পুজো, ভোগে থাকে কী

স্পনসর, থিমপুজো, তারকাখচিত উদ্বোধনের বাইরে শহরে থেকে বেশ খানিকটা দূরে অন্য সাজে সেজে ওঠে পুজোর মণ্ডপগুলো। গ্রামের বাড়ির পুজোর স্বাদ পেতে কোথায় যাবেন?

Advertisement

সায়ন্তনী মহাপাত্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:০৩
Share:

পাহাড় সমান ফুল, বেলপাতা বেছে নির্ঘণ্ট অনুযায়ী গুনে গুনে মালা গাঁথা সারতে হয় পুজো শুরুর আগেই। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।

শহর কলকাতার এই ঝলমলে বিলবোর্ডে ঢাকা রাস্তাগুলো ধরে আরও অনেকটা এগিয়ে গেলে ছোট ছোট যে জনপদগুলোয় এখনও সন্ধে নামার মুখে ঝুপ করে আঁধার নেমে আসে, যেখানে গেরস্ত ঘরের শংখধ্বনি, বাঁশবনের ঝিঁ ঝিঁ পোকার যোগ্য সঙ্গতে তুলসীতলায় আজও সাঁঝবাতিরা রূপকথা তৈরি, সেই মাটির উঠোনে দুর্গাপূজা আসে এক সম্পূর্ণ অন্য রূপে, অন্য গন্ধে।

Advertisement

এখানে শিউলিভেজা সকালের গন্ধ ভেসে এলেই শুরু হয় ঘরের মানুষের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা। এখানে বারোয়ারি পুজোর ডিজের জাঁকজমক নয় মন কাড়ে গ্রামের সম্পন্ন ঘরের পুরোনো পারিবারিক পুজোগুলো। কয়েক দশক বা শতক পুরোনো এই পুজোগুলোর যেটুকু টিকে আছে, তাতে এখন আর বিত্তের ছোঁয়া না-ই থাকুক প্রাণের ছোঁয়া থাকে ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা। বেশির ভাগ পরিবারেরই বংশজরা এখন গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। তবুও হিমঝরা অশ্বিনের আগমন ওরা টের পায় রক্তের ভিতরে।

বঙ্গ দেশের কোনও এক দ্বীপভূমিতেও হয় ঠিক এই রকমই এক পুজো। সারা বছর চুন সুরকির দালান বাড়ি নিশ্চুপে পড়ে থাকে জন্মান্তরের ইতিহাস নিয়ে। সেই কোন কালে কোন রাজার আমলে খাজনা জমা করে মা লক্ষ্মীর অশেষ কৃপা পেয়েছিলেন এ বাড়ির লোক। তার পরে কালে কালে বিদ্যায় বুদ্ধিতেও নিজেদের প্রমাণ করে আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে সকলেই প্রতিষ্ঠিত। বংশের এই ইতিহাস ঘুমিয়েই থাকে কুলুঙ্গির ফাঁকে ঘুন পোকার মতো শুধু শরিকি পুজোর পালা পড়লে, ভারা বেঁধে খানিক ঘরদোর সাফাই এর কাজ শুরু হলে পুরোনো কথা কানাকানি করে ঘরের আনাচ কানাচ।

Advertisement

শহর কলকাতার এই ঝলমলে বিলবোর্ডে ঢাকা রাস্তাগুলো ধরে আরও অনেকটা এগিয়ে গেলে ছোট ছোট যে জনপদগুলোয় এখনও সন্ধে নামার মুখে ঝুপ করে আঁধার নেমে আসে, যেখানে গেরস্ত ঘরের শংখধ্বনি, বাঁশবনের ঝিঁ ঝিঁ পোকার যোগ্য সঙ্গতে তুলসীতলায় আজও সাঁঝবাতিরা রূপকথা তৈরি, সেই মাটির উঠোনে দুর্গাপূজা আসে এক সম্পূর্ণ অন্য রূপে, অন্য গন্ধে।

এখানে শিউলিভেজা সকালের গন্ধ ভেসে এলেই শুরু হয় ঘরের মানুষের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা। এখানে বারোয়ারি পুজোর ডিজের জাঁকজমক নয় মন কাড়ে গ্রামের সম্পন্ন ঘরের পুরোনো পারিবারিক পুজোগুলো। কয়েক দশক বা শতক পুরোনো এই পুজোগুলোর যেটুকু টিকে আছে, তাতে এখন আর বিত্তের ছোঁয়া না-ই থাকুক প্রাণের ছোঁয়া থাকে ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা। বেশির ভাগ পরিবারেরই বংশজরা এখন গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। তবুও হিমঝরা অশ্বিনের আগমন ওরা টের পায় রক্তের ভিতরে।

বঙ্গ দেশের কোনও এক দ্বীপভূমিতেও হয় ঠিক এই রকমই এক পুজো। সারা বছর চুন সুরকির দালান বাড়ি নিশ্চুপে পড়ে থাকে জন্মান্তরের ইতিহাস নিয়ে। সেই কোন কালে কোন রাজার আমলে খাজনা জমা করে মা লক্ষ্মীর অশেষ কৃপা পেয়েছিলেন এ বাড়ির লোক। তার পরে কালে কালে বিদ্যায় বুদ্ধিতেও নিজেদের প্রমাণ করে আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে সকলেই প্রতিষ্ঠিত। বংশের এই ইতিহাস ঘুমিয়েই থাকে কুলুঙ্গির ফাঁকে ঘুন পোকার মতো শুধু শরিকি পুজোর পালা পড়লে, ভারা বেঁধে খানিক ঘরদোর সাফাই এর কাজ শুরু হলে পুরোনো কথা কানাকানি করে ঘরের আনাচ কানাচ।

পুজোর এক মাস আগেই ঠাকুরদালানে শুরু হয় মায়ের মূর্তি গড়ার কাজ। এ বাড়ির পুজোয় সন্তানের আর বস্তুর মঙ্গলার্থে একই মণ্ডপে পূজিতা হন জঙ্গল জননী বিশালাক্ষী আর মা শীতলা। খড়ের কাঠামোর উপরে পড়ে মাটি, তৈরি হয় রাংতা মোড়া শোলার সাজ। ধীরে ধীরে মাটির মূর্তি অবয়ব পায় সর্বংসহা মায়ের। মায়ের চক্ষুদানের আগেই এসে পড়তে থাকেন বাড়ির মানুষজন। ছেলেপুলে, নাতিপুতি নিয়ে প্রায় ১০০ লোকের সংসারে গমগম করতে থাকা সেই বাড়িও তার পুরোনো রূপ ফিরে পায়। ভাঁড়ার ঘর, পুজোর জোগাড়, খাবারের আয়োজন, জলখাবারের ব্যবস্থা, কাঁচা বাজার, অতিথি আপ্যায়ন— সব কাজের ফাঁকে ফাঁকে পুরুষদের আড্ডা বসে লম্বা টানা বারান্দায়। সে বারান্দার মধ্যমণি বড় কর্তা। ভারী শরীর নিয়ে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে তার কাজ হল অতিথিদের খোঁজ নেওয়া। কেউ এলেই হাঁক পড়ে ভিতরমহলে। চায়ের দায়িত্বে থাকা ছোট বউ কাপে কাপে চা সাজিয়ে পৌঁছে দেয় বারান্দায়। পরস্পরের খোঁজ নেওয়া, পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ আর নতুন জামাইকে বসিয়ে তার শ্বশুরের ছোটবেলার দুষ্টুমির কাহিনি শোনানো। সে এক ভারী রগড় চলে বারান্দা জুড়ে। নিজের রগড়ে নিজেই খানিক হা হা করে হাসেন বড় তরফ। আর তার ভারী শরীরের হাসির দমকে দুলতে দুলতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য।

শ’ খানেক নারকোল ভেঙে কুরিয়ে নাড়ু করা, অষ্টমীর দুপুরে লুচির জোগাড়— মেলা কাজ। ছবি: সায়ন মহাপাত্র।

ও দিকে পৌঁছে ইস্তক মুখ ভার করে রেখেছিল যে বছর সাতেকের মেয়েটা, তার এ বার বন্ধুদের সঙ্গে নিজেদের কমপ্লেক্সের পুজোয় থাকার বড্ড সাধ ছিল। কিন্তু বেলা না বাড়তেই দ্যাখো সেই কেমন খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো, পিসতুতো, পাড়াতুতো ভাইবোনদের সঙ্গে মণ্ডপময় ছুটে বেড়াচ্ছে। এ তার কাছে এক ভারী মজার জগৎ। সবাই মিলে সারা দিন খালি হইহই। একসঙ্গে পুকুর দাপিয়ে স্নান করা, খাওয়া, মাছ ধরা, দল বেঁধে বাজার থেকে কটকটি গজা কিনে খাওয়া আর সারা দিন খেলা করার ফাঁকে তার মনখারাপও কখন উধাও।

রান্নাঘরের এক কোণে শুদ্ধাচার মেনে রান্নার ঠাকুর তিন বেলার নিরামিষ রান্না করেন। গেরস্থ ঘরের সাধারণ রান্না, পঙ্‌ক্তি ভোজনের আনন্দে হয়ে ওঠে দেবভোগ্য। জোগাড়ে থাকেন বাড়ির বউ-ঝিয়েরা। কুটনো কোটা, শ’ খানেক নারকোল ভেঙে কুরিয়ে নাড়ু করা, অষ্টমীর দুপুরে লুচির জোগাড়— মেলা কাজ। কিন্তু ক্লান্তি লাগে না মোটেই। তার পরেও রাত থাকতে উঠে স্নান করে, পাটভাঙা কাপড় পরে ঠাকুরের মালা গাঁথতে বসেন তাঁরা। বেতের ধামায় সারা গ্রাম থেকে ফুল, পদ্ম, বেলপাতা এনে উঠোনে উপুড় করে দেয় মালিরা। সেই পাহাড় সমান ফুল, বেলপাতা বেছে নির্ঘণ্ট অনুযায়ী গুনে গুনে মালা গাঁথা সারতে হয় পুজো শুরুর আগেই। হাতের সঙ্গে সমানে চলতে থাকে মুখ, এর ওর পেছনে লাগা, হাসি-মশকরা। সকালের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সেখানে চুপটি করে ওঁদের গল্প শোনেন বুড়ি পিসি। জীবন-সায়াহ্নে এসে এই সকলের একসঙ্গে হওয়ার মুহূর্তইগুলোই তার বাকি দিনগুলির পাথেয়।

গেরস্থ ঘরের সাধারণ রান্না, পঙ্‌ক্তি ভোজনের আনন্দে হয়ে ওঠে দেবভোগ্য।

ভিতরমহলে তখন হাসির রোল। ঘুমকাতুরে ছেলেমেয়েদের ঘুম ভাঙানোর জন্য ন’কাকা কেমন ঘরে ঘরে ঘুরে ঢাক বাজাতে লেগেছেন। সে দেখে কাঁচা ঘুম ভেঙে চোখ কচলে রাগ করবে কি? ফিক করে হেসেই ফেলে ছোট মেয়েটা।

সবাইকে খাইয়ে দুপুরে ঝাল ঝাল আলুর ঝোল, ঘণ্ট আর চালকুমড়ার তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া ফুরোবেই না বউ-ঝিদের। এঁটো হাত শুকিয়ে খড়ি উঠলেও শেষ হবে না তাঁদের আড্ডার ঝুলি। শেষে বড় ঠাকুরঝি এসে খানিক বকা দিলে গতর নড়বে বউগুলোর।

আর বকা না দিয়ে উপায়ই বা কী? বেলা গড়াতেই যে শুরু হবে লোকজন, জ্ঞাতিদের আনাগোনা। ছোট্ট দুর্গা মণ্ডপের আঙিনা জুড়ে পুজোর ক’দিন চলে হরেক খেলনা, বেলুন আর ঝিকিমিকি টিপের বিকিকিনি। সন্ধে হলে শুরু হয় তক্তপোশে কাপড় বিছিয়ে ছোটদের জলসা। আর রাত গড়িয়ে খানিক ঘন হলে শুরু হবে মঙ্গল কাব্যের পালাগান। সুর করে বেহুলা লখিন্দর, ধনপতি সওদাগরের গান বেশ লাগে শুনতে।

দেখতে দেখতে কী এক আবিষ্কারের উত্তেজনায় ছোট মেয়েটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে ভিড়ের মাঝে, ‘‘মা দেখো, সাবিত্রী সেজেছে যে, সে আসলে একটা লোক, বিকেলবেলায় ঘাটে বসে বিড়ি খাচ্ছিল আমি দেখেছি যে!’’

সলাজে মেয়েকে টেনে বসিয়ে দেন মা আর মণ্ডপ জুড়ে ওঠে হাসির রোল । ভারী অপ্রস্তুত লাগে ওই ছোট মেয়ের। ফিসফিসিয়ে মাকে বলে ‘‘বা রে ! আমি দেখলুম যে তখন!’’

সন্ধেয় আবার ফুলকাকির জন্মদিন। ছোটপিসির বুদ্ধিতে খানিক মাখা সন্দেশ চৌকো করে রেখে, ভাঁড়ারের কাজু-কিসমিস সাজিয়ে তৈরি হয়েছে এক ছোট্ট কেক। সন্ধিপুজো এ বছর পড়েছে মাঝরাতে। বিশাল পিতলের প্রদীপখানা মাজতে মাজতে মেজো বউ ভাবেন, জোর করে দুপুরে বাচ্চাগুলোকে আজ খানিক ঘুম পাড়াতে হবে। কিন্তু খাওয়ার পরে তাদের খুঁজে বার করে, সাধ্যি কার। হাতে হাতে প্রদীপ জ্বেলে, ধুনোর গন্ধে চোখ রাঙা করে আরতি শেষ হওয়ার আগেই ইতিউতি ঘুমিয়ে পড়ে তারা ক্লান্ত হয়ে।

এ বাড়ির পুজোয় সন্তানের আর বস্তুর মঙ্গলার্থে একই মণ্ডপে পূজিতা হন জঙ্গল জননী বিশালাক্ষী আর মা শীতলা।

এ ভাবেই ছোট ছোট আনন্দগুলো মুঠি করে বুকের ভেতর ভরতে ভরতে নবমী নিশি পার হয়ে এসে পড়ে দশমী। বাড়িময় আজ ভাঙা হাটের পরিবেশ। এক রাশ মনখারাপের ভারে ধীরলয়ে কাজ চলে আজ। কিন্তু সে বললে চলবে কেন? ঘট বিসর্জনের পর আজ যে সারা গাঁয়ের নেমন্তন্ন। এত দিনের নিরামিষ আহারের পর আজ রান্না হবে মাছ। সেই মাছ ধরা শুরু হয়েছে কাক ভোরে। বাড়ির বড় জামাই যাঁকে ছাড়া সব আনন্দই অসম্পূর্ণ তার আর শ্যালক-শ্যালিকদের পাল্লায় পড়ে নতুন জামাই বেশ খানিক নাকানি-চোবানি খেয়েছে সেই বিশাল জাল ছুড়তে গিয়ে। আপাত গম্ভীর শ্বশুরও তাকে নিদান দিয়েছেন, ‘‘বুঝলে বাবা, এ বছর না হয় ট্রেনিং হল তোমার, পরের বছর কিন্তু জাল ছোড়ার পরীক্ষা নেওয়া হবে।’’ পাশ থেকে হইহই করে ওঠে ছেলেমেয়েরা। ‘‘তা কেন কাকা? এ বছরই ওকে এনে দিতে হবে রাতের খাবারের জন্য আস্ত এক খান খাসি।’’ কিন্তু দাবি করার আনন্দে দাবি করাই সার। নিরামিষ খেতে পারে না যে বাচ্চাগুলো আজ মাছের পাতে খেতে বসে তারাও খোঁজ নেয়, ‘‘জেঠি, কালকের সেই চিচিঙ্গে পোস্ত নেই একটুও?’’

সাঁঝ নামলে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে, অপরাজিতা পূজার শেষে লাইন দিয়ে সকলে হাতে অপরাজিতা লতা বাঁধেন। ঠাকুরমশাই জোগাড় করেন শেষ আরতির। পান, মিষ্টি, ধান দুব্বা, সিঁদুরে সেজে ওঠে মায়ের বরণের থালা। মণ্ডপ ভরা ধুনোর ধোঁয়া, শাঁখ, কংসাল, ঘণ্টা ধ্বনির মাঝে মায়ের বিশাল মূর্তি থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ে ফুল, বেলপাতা। মায়ের মুখ যেন প্রাণ পেয়ে জেগে ওঠে। সে দিকে চেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু নামে বৃদ্ধ বড় ঠাকুরমশাইয়ের চোখ বেয়ে, অব্যক্ত এক কষ্টে গলা বুজে আসে। হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আরতির পঞ্চপ্রদীপ এগিয়ে দেন ছেলের দিকে। দর্পনে, কাঁসার গামলার হলুদগোলা জলে মায়ের মুখ দেখতে দেখতে কান্না আটকান সকলেই। শুধু অপলক চেয়ে থাকে ছোট মেয়েটা, চোখ কচলিয়ে বারে বারে দেখে। পাশের দিদির জামা টেনে বলে, ‘‘দেখ দেখ, মায়ের মুখখানা কেমন নড়ছে।’’

বারান্দায় বসে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষগুলোর ঘোলাটে চোখেও তখন কুয়াশা। জীবনের এই পর্বে সব কিছু বড় অনিশ্চিত লাগে। চোখের জল মুছে দু’চোখ ভরে তাই দেখতে থাকেন এই ভরভরন্ত সংসার। সিঁদুরখেলার শেষে একে তাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মেয়েরা। এ তো শুধু ঘরের মেয়ের বিদায় নয়, এ যে তাঁদের এই বছরের মিলনমেলারও শেষ ঘণ্টা।

পুরুষমানুষ যাঁরা এই ক’দিন কাঁধে কাঁধ দিয়ে সামলে দিয়েছেন সব, তাঁরা কেবল খানিক উদাস হন। নির্জনে পুকুরঘাটের জলের দিকে তাকিয়ে এক খান সিগেরেট ধরান। দু’বেণী বাঁধা মেয়েটা এত কিছু বোঝে না। তবু ছোয়াঁচে মনখারাপ তাকেও খানিক ছেঁকে ধরে বইকি। সম্পর্কে তারই বয়সি দিদির মেয়ের হাত ধরে বার বার শুধায়, ‘‘তুইও তো দিল্লিতেই থাকিস মুনি। আসবি তো আমাদের বাড়ি? বল আসবি তো?’’

ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে পুকুরধারে একলা দেখে বাবাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে মেয়ে, ‘‘তোমার মনখারাপ বাবা?’’ মেয়েকে কোলে টেনে চুলে বিলি কাটতে থাকে বাবার হাত। ওই ছায়া ছায়া হিম পড়া অন্ধকারে খানিক নিশ্চুপে বসে থাকেন ওঁরা। তার পর কথা ঘোরাতে বাবা শুধোন,‘‘কই বললে না তো মা, ঠাকুরের কাছে কী চাইলে?’’ বাবার বুকে মুখ গুঁজে চোখের জল আটকাতে আটকাতে মেয়ে বলে, ‘‘চাইলাম সবার যেন এই রকম একটা দেশের বাড়ি থাকে বাবা, একটা এই রকম পুজো থাকে।’’

পালো বা শটী হলুদের মতো এক কন্দ জাতীয় উদ্ভিদ যার হিন্দি নাম ‘তিখুর’ আর ইংরেজি নাম ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান অ্যারারুট’।

গ্রামের পুজোয় ভোগ, প্রসাদের আতিশয্য কমই থাকে। থালা ভরে সাজিয়ে দেওয়া হয় ফলপাকুড়, বাড়িতে বানানো লুচি, মিষ্টি, পায়েস। সাগরদ্বীপের মহাপাত্র পরিবারের ১২৪ বছরের পুরোনো দুর্গা পূজার এক বিশেষ প্রসাদ হল ‘পালো’ আর ঢিমে আঁচে দুধ ফুটিয়ে তৈরি করা ‘পাতক্ষীরের’ মতো এক ক্ষীর।

পালো বা শটী হলুদের মতো এক কন্দ জাতীয় উদ্ভিদ যার হিন্দি নাম ‘তিখুর’ আর ইংরেজি নাম ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান অ্যারারুট’। বাড়ির আশপাশ থেকে এই গাছ তুলে এনে পালোর গুঁড়ো তৈরি করেন বাড়ির মেয়েরাই। প্রথমে আদার মতো এর কন্দ কুরিয়ে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখা হয় জলে। তার পর রস চিপে রাতভর জল থিতোতে দিতে হয়। সকালে জল আলাদা হয়ে নীচে থিতিয়ে পড়ে দুধ সাদা শটীর গুঁড়ো। একেই রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে ভরে রাখা হয় কাচের বয়ামে। গরমকালে মিছরি দিয়ে পালোর শরবত খেলে ভারী সুন্দর এক ভেজা মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। পুজোয় এই দিয়েই সুজির মতো রান্না করে তৈরি হয় ‘পালো’।

পালো (৪ জনের জন্য)

উপকরণ:

পালোর গুঁড়ো: ১/২ কাপ

চিনি: ৩/৪ কাপ

জল: ১ কাপ

দুধ: ১+১/২ কাপ

ছোটো এলাচ: ৩-৪ টি

পদ্ধতি:

একটা চৌকো বা গোল কানা উঁচু থালায় ঘি মাখিয়ে রাখুন।

এলাচের দানা ছাড়িয়ে নিয়ে মিহি করে গুঁড়ো করে রাখুন।

পালোর গুঁড়ো এক কাপ জলে ভিজিয়ে রাখুন ৩০ মিনিট। চিনি এতে ভাল করে মিশিয়ে দিন।

একটা তলা ভারী পাত্রে দুধ, পালো মেশানো জল ভাল করে মিশিয়ে নিন। খুব কম আঁচে জ্বাল দিয়ে রান্না করতে থাকুন। এই সময় ক্রমাগত একটা খুন্তি বা হাতা দিয়ে পুরো মিশ্রণটা নাড়তে থাকতে হবে, নয়তো তলায় লেগে যাতে পারে বা দলা পাকিয়ে যেতে পারে।

এলাচ গুঁড়ো মেশান।

আস্তে আস্তে রান্না হয়ে এটি ঘন হয়ে যখন পাত্রের গা থেকে ছেড়ে আসবে তখন ঘি মাখানো থালায় ঢেলে ঠান্ডা করতে হবে। ঠান্ডা হলে এটি জমে যাবে।

তখন ইচ্ছে মতো কেটে পরিবেশন করুন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement